চট্টগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস – প্রাগৈতিহাসিক যুগ : আজ থেকে শখানেক বছর আগেও এদেশের পণ্ডিতগণের ধারণা ছিল যে, সুপ্রাচীনকালে চট্টগ্রাম ভূখণ্ডের অস্তিত্ব ছিল না। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় (খ্রি. পূ. ২৪৪৯ অব্দ) অথবা পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদেও (রচনাকাল খ্রি. পূ. ১২০০ অব্দ) চট্টগ্রাম সম্বন্ধে উল্লেখ দেখা যায় না।
পরবর্তীকালের শুক্লযজুর্বেদে উল্লেখ আছে যে, গনডকী নদীর পূর্ব দিকটা জলমগ্ন ছিল। তখন হয়ত চট্টগ্রামের উচ্চতর পর্বতমালার শীর্ষদেশগুলো সবেমাত্র নীল সাগরের অথৈ পানির উপর দেখা যেতে শুরু করেছিল।
১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড পর্বতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের কিছু নিদর্শন আবিষ্কৃত হবার ফলে পণ্ডিতগণের উপরোক্ত অভিমত মিথ্যা প্রতিপন্ন হয় এবং চট্টগ্রাম একটি সুপ্রাচীন দেশ বলে প্রমাণিত হয়। সে সময় সীতাকুণ্ড পর্বতে বাংলাদেশের সুপ্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন নব্য প্রস্তর যুগের অশ্মীভূত (Petrified or Fossilized) কাষ্ঠের তৈরি হাতিয়ার ‘কৃপাণ’ আবিষ্কৃত হয়।” তন্মধ্যে লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে চারখানা, কলকাতা ও ঢাকা মিউজিয়ামে একখানা করে দু’খানা, মোট ছয়খানা কৃপাণ সংরক্ষিত আছে।
১৫ ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত কৃপাণগুলো পরীক্ষা করে ঐতিহাসিক ডক্টর আহমদ হাসান দানী যে অভিমত প্রকাশ করেছেন তার সারমর্ম হলো, সীতাকুণ্ড পর্বতে আবিষ্কৃত কৃপাণগুলো দেখতে অশ্মীভূত, চোখা দীর্ঘায়িত এক একটি কাষ্ঠখণ্ড একপাশে চেপটা খাটো বাঁটযুক্ত উত্তমরূপে পালিস করা।
সমসাময়িককালে আসামের কামরূপেও অনুরূপ নব্য প্রস্তর যুগের কাষ্ঠের তৈরি কৃপাণ আবিষ্কৃত হয়। তা থেকে পণ্ডিতগণ ধারণা করেন যে, আট থেকে দশ হাজার বছর আগে দক্ষিণ আরবের গোলমাথাবিশিষ্ট (Brachycephals) জনগোষ্ঠী চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশ ও আসামে বসতি স্থাপন করেছিল।
১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম জেলার উত্তর সীমান্ত সংলগ্ন নোয়াখালী জেলার ছাগলনাইয়া গ্রামে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রস্তর যুগের কাষ্ঠের তৈরি হাতিয়ার, যথাক্রমে একখানি হাতকুড়াল ও একটি বাটালি। তার ফলে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রাচীনত্বের পরিধি আরো বিস্তৃত হলো। সে হাতিয়ার দু’খানি ঢাকা মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
মহাভারতে বর্ণিত কিরাত রাজ্য, গ্রীক ভৌগিলকদের বর্ণিত কিরাদীয় রাজ্য বলে যে রাজ্যটির উল্লেখ দেখা যায়, পণ্ডিত ম্যাকক্রিন্ডল ও পার্জিটার সাহেব চট্টগ্রামকে সেই রাজ্যের অন্তর্গত বলে করেন। কিংবদন্তি সূত্রে জানা যায় যে, মহাভারতীয় যুগে চট্টগ্রাম বলির পুত্র সুহ্মর রাজ্য সুহ্ম দেশের অন্তর্গত ছিল। অতপর কর্ণের পুত্র বিকর্ণ চট্টগ্রামে রাজত্ব করেন। তাঁর রাজধানী ছিল কাঞ্চননগর।
ফটিকছড়ি ও পটিয়ায় দুটি কাঞ্চননগর আছে। এ দুটো স্থান বিকর্ণের রাজধানীর গৌরব দাবি করে। নোয়াখালী জেলার সিলুয়া গ্রামে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে ব্রাহ্মীলিপিতে উৎকীর্ণ শিলালিপির অবস্থিতি থেকে পণ্ডিতগণ ধারণা করেন যে, নোয়াখালী চট্টগ্রাম মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত অথবা সংস্কৃতির প্রভাবাধীন ছিল।
চন্দনাইশ ছিল পটিয়া উপজেলার একটি অংশ। ১৯৭৬ সালে পটিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে চন্দনাইশ থানার সৃষ্টি করা হয়। উল্লেখিত কাঞ্চননগর বর্তমান চন্দনাইশের অংশে বিদ্যমান।
সূত্র : বন্দর শহর চট্টগ্রাম – আবদুল হক চৌধুরী ১৯৯৪
Comments