in

চট্টগ্রামের পর্তুগিজ নগরী ‘অংগারকেল’ কোথায় ছিল?

চট্টগ্রামের পর্তুগিজ নগরী ‘অংগারকেল’ কোথায় ছিল?

চট্টগ্রামের পর্তুগিজ নগরী ‘অংগারকেল’ এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী প্রাচীন পর্তুগিজ শহর ‘অংগারকেল’ কোথায় হারিয়ে গেল, তা এক ঐতিহাসিক বিস্ময় ও প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের বিষয়!

আধুনিক মানচিত্রে এখন আর ‘অংগেরকেল’ নামে কোন স্থানের অস্তিত্ব না থাকলেও, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. আবদুল করিম মনে করেন, চট্টগ্রামের দেয়াঙ-এর (আনোয়ারা উপজেলা) পার্শ্ববর্তী বাঁশখালী উপজেলার সমুদ্র তীরবর্তী পশ্চিমাঞ্চলের লোকদের মনে ‘অংগারকেল’-এর স্মৃতি ও পরিচিতি সম্পর্কে কোনও দ্বিধা নেই। ম্যানরিক বর্ণিত পর্তুগিজ জনপদ ‘অংগারকেল’ প্রকৃতপক্ষে ‘অংগারখালী’ যা স্থানীয়ভাবে ‘অঁঙ্গারখালী’ নামে উচ্চারিত হয়।

বস্তুতপক্ষে, অঁঙ্গারখালী চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার খানখানাবাদ গ্রামের ঠিক পশ্চিমে সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত ছিল। গ্রামটি বর্তমানে সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু নামটি এখনো প্রবীণদের স্মৃতিতে এবং স্থানীয় লোকশ্রুতিতে বিরাজমান রয়েছে। ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. আবদুল করিম, যিনি এই অঞ্চলের একজন বাসিন্দাও, উল্লেখ করেছেন, ‘আমি ছোটকালে বয়োবৃদ্ধদের কাছে সমুদ্র গর্ভে বিলীন হওয়া তিনটি স্থানের নাম শুনেছি। সেগুলো হলো : অংগারখালী, বালুখালী এবং চন্দন্যা হাট। ’

চট্টগ্রামে ভগ্নপ্রায় পর্তুগিজ ভবন।
চট্টগ্রামে ভগ্নপ্রায় পর্তুগিজ ভবন। ছবি : ডেইলি স্টার

অংগারখালী উল্লেখ পাওয়া যায় পর্তুগিজ-পরবর্তীকালে আগত ইংরেজ কোম্পানির রেকর্ডে। ১৭৬০ সালে ইংরেজ কোম্পানি চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব লাভ করে। ইংরেজদের ভূমি বন্দোবস্তের এক পর্যায়ে দেখা যায় যে, জন গ্রে নামক একজন ইংরেজ ব্যবসায়ী ব্রিটিশ কোম্পানির কাছ থেকে বাঁশখালী এলাকার ২৫ দ্রোণ ভূমি বন্দোবস্ত নেন। সেই জমি অংগারখালী খাল ও চাম্বল খালের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ছিল বলে উল্লেখিত হয়েছে।

মনে করা হয়, বর্তমানে বাঁশখালী উপজেলার বুক চিরে যে খাল প্রবাহিত, তার কোনও অংশ একদা অংগারখালী খাল নামে পরিচিত ছিল। ১৮৩৬-৩৭ সালে পরিচালিত সিডান জরিপে অংগারখালীর নাম পাওয়া যায় না। ফলে স্থানটি তারও বহু আগে সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে কালের অতল গর্ভে হারিয়ে গেছে বলে প্রতীয়মান হয়। ম্যানরিককে বলা যায় অংগারখালী বা অংগারকেলের গোড়া পত্তনকারী।

আরাকানের রাজার ফরমান এবং রামু’র গর্ভনরের নিবন্ধন নিয়ে তিনি স্থানটিকে বসতির উপযোগী করেন এবং আশেপাশের খ্রিস্টানদের সেখানে একত্রিত করেন। প্রসঙ্গত, এটা অনুমান করা সম্ভব যে, স্থানটি চট্টগ্রামস্থ আরাকানের গর্ভনরের অধীনে ছিল না; ছিল রামু’র গর্ভনরের আওতাধীন।

নানা ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, অংগারখালীর নব্য বসতির খ্রিস্টানরা সবাই গরীব শ্রেণির মানুষ ছিল এবং তারা ছিল ধর্মান্তরিত স্থানীয় খ্রিস্টান। সাদা চামড়ার পর্তুগিজ খ্রিস্টানরা দেয়াঙ ছেড়ে এখানে বসবাস করতে এসেছিল বলে কোনও প্রমাণ নেই। আসা-যাওয়া থাকলেও দেয়াঙ-এর খ্রিস্টানরা আংগারকেলকে এড়িয়ে চলতো। পেশাগত দিক থেকে এখানকার স্থানীয় খ্রিস্টান বাসিন্দারা ছিল জেলে সম্প্রদায়ভুক্ত। গভীর সমুদ্রে মাছ ধরাই ছিল তাদের একমাত্র পেশা।

ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে এবং অন্যান্য খ্রিস্টান বসতি থেকেও মানুষ এসে এখানে বসবাস করে। বিশেষত ‘পর্তুগিজ দস্যু’রা গ্রাম বাংলা থেকে লোকজনকে ধরে বা বন্দি করে এখানে নিয়ে আসতো। অনেককেই জোরপূর্ক খ্রিস্টান করে এখানে রাখা হতো। বাকীদের দাস হিসাবে জাহাজে করে দূরদেশে নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হতো। এখানে পর্তুগিজদের সাহায্য করার জন্য একদল সহ-লুটেরা ও লাঠিয়াল বাহিনি তৈরি করা হয়েছিল।

এমন নৌবহরেই আসে পর্তুগিজরা।
এমন নৌবহরেই আসে পর্তুগিজরা। ছবি : ইন্টারনেট

ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে আরো জানা যায়, পর্তুগিজ ধর্মযাজক ম্যানরিক অংগারখালী গির্জায় স্থানীয় খ্রিস্টান পরিবারের প্রধানদের নিয়ে একটি সভা করেন, যাতে সাতানব্বই জন খ্রিস্টান পুরুষ-গৃহকর্তা উপস্থিত ছিল। ম্যানারিক তাদের বলেন যে, সকল খ্রিস্টানকে অংগারকেলে রাখার জন্য তিনি আরাকানের রাজার অনুমতি লাভ করেছেন।

তাই তাদের সকলকে গির্জায় থাকা উচিত। তিনি গির্জার পাশে বাড়ি করে পরিবার-পরিজন নিয়ে নতুন খ্রিস্টানদের বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন এবং তাদেরকে খ্রিস্টধর্মসম্মত পোশাক ও খোরাকির ব্যবস্থা করেন। ম্যানরিক সুস্পষ্ট আদেশ দেন যে, যারা স্ত্রী-পুত্র-পরিবার-পরিজনসহ খ্রিস্টধর্মের আওতায় আসবে না, তাদেরকে বহিস্কার করা হবে এবং যাদের পরিবারের সদস্যরা নতুন ধর্মের বিধান অনুসরণ করবে না তাদেরকে পরিত্যাগ করতে হবে।

অংগারখালীতে দেশীয় খ্রিস্টানদের সঙ্গে কথা-বার্তা বলে এবং খ্রিস্ট ধর্মের বিকাশে প্রয়োজনীয় বিধি-ব্যবস্থা করে ম্যানরিক দেয়াঙ-এর প্রধান গির্জায় চলে আসেন। তিনি এখানে গির্জায় সারমন বা ধর্মীয় বক্তৃতা দেওয়ার সময় দেশীয় ও স্থানীয় খ্রিস্টানদের জন্য অংগারখালীতে আবাসস্থল তৈরি এবং তাদের পোশাক ও এক মাসের জীবিকার ব্যবস্থা করার জন্য তহবিল গঠনের আবেদন জানান।

পর্তুগিজরা দস্যুতা ও বর্বরতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকলেও ধর্মের ডাকে পুণ্য লাভের লোভে এগিয়ে আসে এবং ম্যানরিক আশানুরূপ তহবিল সংগ্রহে সমর্থ হন। এই অর্থ দিয়ে তিনি অংগারখালীতে বাঁশ ও খড়ের ঘর নির্মাণ করে দেন। তিনি একজন নারী পাদ্রিও সেখানে নিয়োগ করেন, যাতে নারীদের খ্রিস্টিয় আচারে শিক্ষিত করা যায় এবং স্থানীয়দের পূর্বতন ধর্মের অভ্যাস থেকে বের করে আনা যায়। অল্প দিনেই গির্জার অধীনে দু’শ’ তেইশটি পরিবার সংঘবদ্ধ হয়। এদের মোট পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচশ’ বছর আগের হিসাবে বেশ কম ছিল না।

এভাবেই এখানে নিভৃতে খ্রিস্ট ধর্ম বিকাশ লাভ করতে থাকে। পর্তুগিজ দস্যুরাও লোকজন বন্দি করে নিয়ে এসে এখানকার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে। বলা যায়, বৃহত্তর চট্টগ্রামের খিস্ট ধর্ম প্রচার ও বিকাশের আদি ইতিহাস মিশে আছে ম্যানরিক ও অংগারখালীর সঙ্গে।

ড. মাহফুজ পারভেজ : প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

What do you think?

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

চট্টগ্রামের আসল নাম কি? খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেলো প্রায় অর্ধশত নাম! পাল বংশের শাসনামলে আরব পর্যটক ও ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রাম বন্দরকে ‘সমন্দর’ নামে চিনতেন। ধর্মপালের শাসনামলে চট্টগ্রাম তার অধীনে ছিল। দশম ও একাদশ শতকে দক্ষিণ পূর্ববঙ্গে ও আরাকানে চন্দ্র রাজারা ছিলেন চট্টগ্রামের শাসক।

চট্টগ্রামের আসল নাম কি?

সংক্ষেপে সীতাকুণ্ড

সংক্ষেপে সীতাকুণ্ড