ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থল চট্টগ্রাম। এখানকার বৌদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য অতি সুপ্রাচীনকালের। সুস্পা কাহ্নপো লিখিত পাগসাম-জোন-জন ও লামা-তারানাথ লিখিত ‘কাবাভদুন দন’ নামক তিববতীয় গ্রন্থদ্বয় সূত্রে জানা যায় যে, চট্টগ্রামের আদি নাম ছিল ‘জালনধারা’। পরবর্তী সময়ে ‘জলন্দর’ রূপ প্রাপ্ত হয়। এর অর্থ তপ্ত জল সমন্বিত অঞ্চল। (১)
সম্ভবত এখানকার ভূগর্ভ থেকে নিঃসৃত উষ্ণ জলের প্রস্রবণধারা থেকে এ নামের উৎপত্তি। (সীতাকুন্ড পর্বতের বাড়বকুন্ড, কুমারীকুন্ড, লবণাক্ষ্য প্রভৃতি কুন্ড থেকে আজো উষ্ণ জলের প্রস্রবণধারা প্রবাহিত হয়)।
সিন্ধু দেশীয় বৌদ্ধ সিন্ধু বালপাদ এখানে কিছুকাল বাস করে সাধনা করেছিলেন বলে জালন্ধরী পাদ নামে খ্যাত হয়েছিলেন। তার অপর নাম হাড়িফা। তিনি ঝাড়ুদার হাঁড়ির কাজ করেছিলেন বলে এই নামেও পরিচিত ছিলেন।
সুপ্রাচীনকাল থেকে খৃস্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যবর্তী কালের চট্টগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। সম্ভবত তখন এখানে অরণ্যচারী আদিম জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। আরাকানের প্রাচীন রাজাদের ইতিহাস রাজোয়াং সূত্রে জানা যায় যে, ১৪৬ খৃস্টাব্দে মগধের চন্দ্রসূর্য নামক একজন সামন্ত সৈন্য-সেনা নিয়ে আদিম জড়োপাসক জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত ও পশ্চাদপদ অঞ্চল চট্টগ্রাম-আরাকান অধিকার করেন এবং তিনি সেখানকার রাজা হন। তার সঙ্গে আগত মগধের হিন্দু-বৌদ্ধ সৈন্য-সেনারা সেখানে হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেন। তিনি আরাকানে মহামুনী বুদ্ধ মন্দির ও মূর্তি স্থাপন করেন।
তখন থেকে খৃস্টীয় পঞ্চম শতক অবধি চট্টগ্রাম ও আরাকান একটি অখন্ড রাজ্য রূপে আরাকানের চন্দ্র সূর্য রাজবংশের রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল। (২)
ষষ্ঠ শতকে চট্টগ্রাম সমতটের খড়গ রাজবংশের বৌদ্ধ রাজাদের শাসনাধীনে ছিল। (৩)
সপ্তম শতকে চট্টগ্রাম সমতটের বৌদ্ধ দেব রাজবংশের রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল। (৪)
অষ্টম শতকের প্রথমার্ধে চট্টগ্রাম আরাকানের রাজাদের অধীনে ছিল। অষ্টম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে চট্টগ্রাম পাল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। আরব ভৌগোলিক সুলায়মান (৮৬১ খৃ.), খুরদাদ বেহ (৯২২ খৃ.), আল মাসুদী (৯৫৬ খৃ.) প্রমুখের লিখিত বিবরণ অনুসরণে ডক্টর হোদীওয়ালা (৫) ও ডক্টর আহমদ হাসান দানী (৬) বলেন যে, গুজ্জর (JURZ) প্রতিহাররাজ ও দাক্ষিণাত্যের বল্লভ রায় (BALHR)-এর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত পালবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ধর্মপালের (৭৭০-৮১০ খৃ.) রাজত্বকালে চট্টগ্রাম পাল সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল।
রাজা ধর্মপাল শাসিত বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলের রাজধানী ছিল রাহমী বা রাহমা, বৃহত্তম চট্টগ্রামের রামু। পাল রাজাদের তাম্রশাসনে বর্ণিত তাদের ‘সমুদ্রকূল উদ্ভূত’ উক্তি থেকে আধুনিক গবেষকদের অভিমত যে, বৃহত্তম চট্টগ্রামের বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী রামু অঞ্চলেই বাংলার পালরাজ বংশের উৎপত্তি। (৭)
নবমশতকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলা নিয়ে গঠিত হরিকেল রাজ্যভুক্ত ছিল। হরিকেলের রাজধানী ‘বর্ধমানপুর’-এ উৎকীর্ণ রাজা কান্তি দেবের তাম্রশাসনাটি আবিষ্কৃত হয়েছিল পটিয়া থানার ‘বড়উঢান’ অঞ্চলে।
ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার ও ডক্টর রাধাগোবিন্দ বসাক বলেন, এই বর্ধমানপুর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান অভিন্ন। (৮)
ডক্টর সুনীতিভূষণ কানুনাগো বলেন, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান হরিকেলের রাজধানী বর্ধমানপুর হতে পারে না। কারণ ইউ-হে নামক একজন চৈনিক ভ্রমণকারী হরিকেল রাজ্যের অবস্থান সম্পর্কে বলেন, হরিকেল রাজ্য সিংহল থেকে সমুদ্রপথে তিরিশ দিনের পথ এবং নালন্দা থেকে একশ’ যোজন বা আটশ’ মাইল দূরে অবস্থিত। (৯)
ইউ-হের বর্ণনা মতে হরিকেল সমুদ্র তীরবর্তী রাজ্য ছিল ও নালন্দা থেকে আটশ’ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। রাজা কান্তিদেবের তাম্রশাসনের প্রাপ্তিস্থান বড়উঢান বঙ্গোপসাগরের দুতিন মাইলের মধ্যে ও ইউ-হের বর্ণিত নালন্দার আটশ’ মাইল দূরত্বের সাথে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লার সামগ্রিক ভূখন্ডের পরিমাপ মিলে যায় মোটামুটিভাবে। সুতরাং আমাদের মতে সম্ভবত এই বড়উঢানেই হরিকেলের রাজা কান্তিদেবের রাজধানী অবস্থিত ছিল। বড়উঢান বর্ধমানপুরের বিকৃত রূপ। (১০)
১৯২৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে উক্ত বড়উঢান গ্রামের পাঁচ মাইল দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত আনোয়ারা উপজেলার ‘ঝিয়রী’ গ্রামের সহর আলী বলী বাড়ি তৈরি করার জন্য ভিটির মাটি কাটার সময় ছেষট্টিটি পিতলের তৈরি বুদ্ধমূর্তি আবিষ্কৃত হয়। লোকমুখে এ সংবাদ জেনে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের পালি ভাষার তৎকালীন অধ্যাপক ধর্মবংশ মহাথেরো দীপংকর নামক একজন ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে ঝিয়রী গ্রামের সহর আলী বলীর বাড়িতে যান। এবং তাঁকে প্রাপ্ত মূর্তিগুলো চট্টগ্রাম শহরের বৌদ্ধ বিহারে সংরক্ষিত করার জন্য দান করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু সহর আলীর বলী দিতে অস্বীকার করেন।
তখন অধ্যাপক ধর্মবংশ মহাথেরো শহরে ফিরে এসে এই মূর্তি আবিষ্কারের সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশ করে দেন। সে বছর এপ্রিল মাসে এ সংবাদ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধায়কের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি চট্টগ্রামের কালেক্টারের কাছে উক্ত প্রত্ন-সম্পদ আইনবলে সংগ্রহ করার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি সহর আলী বলীর কাছ থেকে মূর্তিগুলো উদ্ধার করে চট্টগ্রাম ট্রেজারিতে নিয়ে আসেন। এবং পরবর্তীতে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কার্যালয়ে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই ছেষট্টিটি মূর্তির মধ্যে ঊনষাটটি কলকাতা জাদুঘরে, পাঁচটি কলকাতার আশুতোষ সংগ্রহালয়ে ও দুটি বোম্বের ভিকটোরিয়া আলবার্ট সংগ্রহালয়ে সংরক্ষিত রয়েছে।
মূর্তি বিশেষজ্ঞ অলোক ভট্টাচার্যের মতে, ঝিয়রীর মহাযান ও তন্ত্রযান ধারায় তৈরি বুদ্ধ মূর্তিগুলোকে ছয় ভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা উপবিষ্ট ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় বুদ্ধমূর্তি; দন্ডায়মান ও অভয় ব্যাখ্যান মুদ্রায় বুদ্ধমূর্তি, মৈত্রেয় ও লোকেশ্বরসহ বুদ্ধমূর্তি, পদ্মপানি, লোকেশ্বর, মঞ্জুশ্রী, বসুধারা, চুন্ডামূর্তি, ছত্রসহ স্তূপ ও মহারোমি মন্দিরের প্রতিমূর্তি। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে একদা চট্টগ্রাম ছিল ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চার সংযোগস্থল। এই মূর্তিগুলো নবম শতকে নির্মিত হয়েছিল।(১১)
সুতরাং অনুমান করা যায় যে, হরিকেলরাজ কান্তিদেবের রাজত্বকালে রাজধানী বর্ধমান- পুরে (বড়উঢানে) এই মূর্তিগুলো নির্মিত হয়েছিল। চট্টগ্রামে বৌদ্ধ রাজত্ব অবসানের পর স্থানীয় বৌদ্ধ অধিবাসীরা লুণ্ঠন বা ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এই মূর্তিগুলো বড়উঢানের কিছুটা দূরবর্তী স্থান ঝিয়রী গ্রামে কোনো বিশেষ স্থানে মাটির নিচে লুকিয়ে রেখেছিল।
পরবর্তীকালে হয়তো তারা অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হওয়ায় মূর্তিগুলো সেখানে থেকে যায়। তারপর কালক্রমে সেখানে বাস্তুভিটা নির্মিত হয়েছিল। বড়উঢানের দেয়াঙ্গ পাহাড়ের বিশ্বমূঢ়ার ‘বিসম রাজার’ বাড়ির ধ্বংসস্তূপে মাটি খুঁড়ে ইট সংগ্রহকালে আজো মাঝেমধ্যে বিভিন্ন ধরনের বুদ্ধমূর্তি পাওয়া যায়। (১২)
দশম শতকের প্রথমার্ধে চট্টগ্রাম পাট্টিকারার চন্দ্রবংশের রাজাদের শাসনাধীনে ছিল এবং পাট্টিকারার চন্দ্র রাজবংশের সাথে আরাকানের চন্দ্রবংশের রাজাদের জ্ঞাতিসম্পর্ক ছিল। প্রচলিত মতো এই যে, মহাবীর আরাকানের চন্দ্র রাজবংশের উৎখাত করলে ওই বংশের একটি শাখা পাট্টিকারার রাজ্য গঠন করে রাজত্ব করতে থাকেন। এই সম্পর্ক স্বীকার করার প্রধান কারণ এই যে, পাট্টিকারার চন্দ্রদেব উৎকীর্ণ মুদ্রায় আরাকানের চন্দ্রদেব মুদ্রার বিশেষভাবে মিল দেখা যায়। তাছাড়া পাট্টিকারার চন্দ্রদের সাথে আরাকানের চন্দ্র রাজবংশের বৈবাহিক সম্পর্কেও বিবরণ পাওয়া যায়। (১৩)
পাট্টিকারার চন্দ্র রাজবংশের শাসনকালে চট্টগ্রামে পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। তিববত বিশেষজ্ঞ পন্ডিত শরচ্চন্দ্র দাস লামা তারানাথের তিববতী গ্রন্থ থেকে পন্ডিতবিহার সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেন। তৎকালীন চট্টগ্রামের পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পূর্ববঙ্গে মহাযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মবিষয়ক শিক্ষা ও ধর্মপ্রচারের প্রধান কেন্দ্র।
পন্ডিতবিহারের প্রধান অধ্যক্ষ ছিলেন পটিয়া উপজেলার চক্রশালা নিবাসী ব্রাহ্মণ সন্তান তিলপাদ। এই তিলপাদ নামের উৎপত্তি সম্পর্কে জানা যায় যে, তার হিন্দু জীবনের যোগসাধন সঙ্গিনী তিল পিষে জীবন ধারণ করতেন বলে তিনি তিলপাদ নাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মহাযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার পর প্রজ্ঞাভদ্র নাম গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে প্রজ্ঞাভদ্র পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
সেখানকার বৌদ্ধ পন্ডিতদের প্রধান কাজ ছিল মহাযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধদের পূজার জন্য অসংখ্য বৌদ্ধ দেবদেবীর কল্পনা করা, তাদের মন্ডল আঁকা ও স্তব স্তোত্র, ধারণী মন্ত্র এবং তাদের টীকা-টিপ্পনী সমেত গ্রন্থ রচনা করা। পন্ডিতবিহারের অধ্যক্ষ প্রজ্ঞাভদ্র সংস্কৃত ও পালি মিশ্রিত ভাষায় নিম্নলিখিত ছয়খানি গ্রন্থ রচনা করেন :
১. শ্রী সহজ শম্বরস্বাধীষ্টান,
২. অচিন্ত্য মহামুদ্রনাম,
৩. তত্ত্ব চতুরোপদেশ প্রসন্নদীপ,
৪. যোহা কোষ,
৫. ষড় ধর্মোপদেশ ও
৬. মহামন্ত্রোপাদেশ।
উল্লেখ্য যে, প্রজ্ঞাভদ্র রচিত তিনটি গ্রন্থে এমন কিছু তথ্য লিপিবদ্ধ দেখা যায় তাতে তার জন্মস্থান সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ আছে। তার রচিত শ্রীসহজ শম্বরস্বাধীষ্টান গ্রন্থে তিলপাদ ও প্রজ্ঞাভদ্র এই দুই নামের উল্লেখ দেখা যায়। তার অচিন্ত্য মহামুদ্রনাম গ্রন্থখানি ‘যশঃপালপুরঃ নামক একটি জায়গায় লিখিত হয়েছিল। এই স্থান চট্টগ্রামে অবস্থিত না হলে বুঝতে হবে প্রজ্ঞাভদ্র সারাজীবন পন্ডিতবিহারে কাটাননি, হয়তো কিছুকাল উক্ত জায়গায় ছিলেন।
তত্ত্ব চতুরোপদেশ প্রসন্নদীপ গ্রন্থে তিলপাদকে ‘উড্ডীয়ানের’ লোক বলা হয়েছে। পাগসাম-জোন-জনের মতে উড্ডীয়ান তান্ত্রিক বৌদ্ধদের চারটি পীঠস্থানের অন্যতম বলা হয়েছে। এর অবস্থান নিয়ে প্রচুর মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। কেউ বলেন উড্ডীয়ান উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে (বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত), কেউ বলেন উড়িষ্যায়, কেউ বলেন আসাম, আর কেউ বলেন চট্টগ্রামে। (১৪)
পন্ডিতবিহারের অবস্থান নিয়েও পন্ডিত মহলে প্রচুর মতভেদ দেখা যায়। চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লার রঙমহল পাহাড় বা বর্তমান জেনারেল হাসপাতালের পাহাড়, পটিয়ার চক্রশালা, সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়, দেয়াঙ্গ পাহাড়, মিরসরাইর পরাগলপুরে ছুটিখাঁর দিঘির সন্নিকটে পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত ছিল বলে পন্ডিতগণ মত প্রকাশ করেন।
৯৫৩ খৃস্টাব্দে আরাকানরাজ সুলত-ইং-চন্দ্র নিজ রাজ্যের উত্তর সীমান্তবর্তী ভূখন্ডের থুরতন বা সুলতানকে পরাজিত করে কুমিরার কাউনিয়া ছড়ার দক্ষিণ তীর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে একটি বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করতে তাতে চিং-তৌং-গৌং (যুদ্ধ করা অনুচিত) রানী উৎকীর্ণ করে আরাকানে ফিরে যান। এই চিৎ-তৌং-গৌং থেকে চট্টগ্রাম নামের উদ্ভব বলে কোনো কোনো পন্ডিত মনে করেন। (১৫)
১৭৬০ খৃস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী (চট্টগ্রামের) দেওয়ানি শাসকের কর্তৃত্ব লাভ করার পর ইসলামাবাদ বা চট্টগ্রাম শহরের নিকটবর্তী একটি স্থানে তিন হাত দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীর পরিমাপের একটি ইস্টকবেষ্টিত গুহায় আরাকানি ভাষায় উৎকীর্ণ চান্ডিলা রাজার রৌপ্যলিপি আবিষ্কৃত হয়। এবং চট্টগ্রামের তৎকালীন ইংরেজ শাসনকর্তারা তা কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়।
১৭৯৪ খৃস্টাব্দে স্যার জনশোর (লর্ড টিন মাউথ) লিপিটির মূল আরাকানি পাঠ ছাড়া একটি ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। তা নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো :
Oh the 14th Magha 904 Chandi Lal Raja, by the advice of Bowangari Rouli, who was the director of his studies and devotions and in conformity to the sentiments of twenty-eight other Roulis, formed the design of establishing a place of religious worship, for which purposes a cave was dug and paved with bricks, three cubits in depth and three cubits also in diameter, in which were deposited one hundred and twenty bronze images of small dimension denominated Tharnudas also, twenty bronze images large than the former, denominated Languda: There was likewise a large image of stone call (Sic) Langudagari with a vessel of Brass, in which were deposited two of the bones of thacur. On a silver plate were inscribed the Hanca or the mandates of the deity with that also styled Thumah Chucksowana and Tahma to the study of which twenty-eight Roulis devote their time and attention; who having celebrated the present work of devotion with festivals and rejoicings, erected over the cave a place of religious worship for the magas in honor of the deity. (১৭)
এর পরে বুদ্ধদেবের জীবনকাহিনী বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ আছে। এর সারমর্ম হলো : ১৪ মাঘ ৯০৪ সালে চান্ডিল্য রাজা স্বীয় ধর্মগুরা ভাওয়াঙ্গিরী রাউলীর উপদেশে ও তার আটাশজন রাউলী শিষ্যের সম্মতিক্রমে একটি উপাসনালয় প্রতিষ্ঠার করার পরিকল্পনা করেন। সে উদ্দেশ্যে ৩ হাত দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীর পরিমাপের একটি ইস্টক, বাঁধানো গুহায় রক্ষিত হলো ‘তাহমুদাস’ নামক একশত কুড়িটি পিতলের তৈরি ছোট মূর্তি, মাঝারি আকারের ‘লাঙ্গুদা’ নামক কুড়িটি পিতলের মূর্তি ও একটি বড় আকারের পাথরের তৈরি, লাঙ্গুদামারী মূর্তি ও তার সঙ্গে একটি পিতলের পাত্রে রক্ষিত হয় ঠাকুরের দুটি হাড়, একটি রৌপ্য পাতে ‘হাওকা’ বা দেবতার অনুশানাবলী উৎকীর্ণ করা হয়- থোমহা চাক-সোয়ানা থামহা।
এখানে এই উপসনালয় স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল আটাশজন বাউলী সাধনভজন ও আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে ধর্মানুশীলন করা। এবং গুহার ওপর স্থাপিত উপাসনালয় মগদের ধর্মাচরণের পবিত্র পীঠস্থান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। অতঃপর বৃদ্ধজীবনী উৎকীর্ণ করা হয়। পন্ডিত শরচ্চন্দ্র দাশ উক্ত লিপির তারিখ মগী সন ধরে ৯০৪ + ৬৩৮ = ১৫৪২ খৃস্টাব্দ স্থির করে চান্ডিল্য রাজাকে আরাকান রাজ মিনবিন জবৌক শাহর (১৫৩১-১৫৫৩ খৃ.) অধিকৃত চট্টগ্রামের সামন্ত রাজা বলে চিহ্নিত করেছেন। (১৮)
ডক্টর সুনীতি ভূষণ কানুনগোও এই মতো সমর্থন করেন। (১৯)
কিন্তু ডক্টর আবদুল করিম বলেন, তাদের সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। কারণ রাজার নাম উল্লেখ ছাড়া কোনো সামন্ত রাজার লিপি উৎকীর্ণ করার নিয়ম নেই। এবং আরাকানি রাজার উৎকীর্ণ লিপিতে মগী সনের সঙ্গে মগী মাসের নাম না দিয়ে বাংলা মাঘ মাসের নাম দেওয়াতে চান্ডিল্য রাজা স্থানীয় রাজা বলেই প্রমাণিত হয়। সুতরাং উক্ত রৌপ্যলিপির সনটি শকাব্দ ৯০৪+৭৮=৯৮২ খৃস্টাব্দে। (২০)
উল্লেখ্য যে, ৯৫৩ খৃস্টাব্দে আরাকানের রাজা ছিলেন সুলত-ইং-চন্দ্র। আর ৯৮২ খৃস্টাব্দে) আরাকানের রাজা ছিলেন বৈশালীর চন্দ্র রাজবংশের মিউ গোত্রের প্রধান অমাহতু (Amyahtu)। ব্রহ্মদেশের পঁগারাজ অনরহট ১০৫৭ খৃস্টাব্দে উত্তর আরাকান এবং ১০৫৯ খৃস্টাব্দে চট্টগ্রাম ও পাট্টিকারা রাজ্য জয় করেন (২১) এবং ব্রহ্মদেশ, আরাকান, চট্টগ্রাম ও পাট্টিকারায় প্রচলিত মহাযান বৌদ্ধমতো উচ্ছেদ করে হীনযান বা থেরবাদ বৌদ্ধমত প্রচার করেন। (২২)
পগা ও পাট্টিকারা রাজপরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল। (২৩)
১২৩০ খৃস্টাব্দে সমতটের বৌদ্ধ রাজা দামোদর দেব (১২৩০-১২৫৩ খৃ.) পাট্টিকারাসহ চট্টগ্রাম জয় করে ১২৫৩ খৃস্টাব্দে অবধি রাজত্ব করেন। (২৪)
চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার রামপুর গ্রামে ১৮৭৩ খৃস্টাব্দে একটি ও ১৯৭৮ সালে সীতাকুন্ড থানার সলিমপুর গ্রামে দুটি, মোট তিনটি রাজা দামোদর দেবের তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে। (২৫)
১২৫৪ খৃস্টাব্দে পঁগারাজ পুনরায় চট্টগ্রাম পাট্টিকারা অধিকার করেন। কিন্তু দু’বার পঁগা অধিকৃত উত্তর আরাকানের সামন্ত রাজা মেংদী ১২৮৩ খৃস্টাব্দে স্বাধীন হয়ে যান। এবং চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র নদের তীর অবধি ভূভাগ জয় করে আরাকান রাজ্যভুক্ত করেন। (২৬)
তখন থেকে ১৩৩৯ খৃস্টাব্দে অবধি চট্টগ্রাম আরাকানের শাসনাধীন ছিল। উপরোক্ত বিবরণ পাঠ করে জানা যায় যে, ১৪৬ খৃস্টাব্দ থেকে ১৩৩৯ খৃস্টাব্দে অবধি হাজার অধিক বছরকাল চট্টগ্রাম নিরবচ্ছিন্নভাবে আরাকান, সমতট, হরিকেল, পাট্টিকারা, পূর্ববঙ্গের চন্দ্র ও ব্রহ্মদেশের পঁগার বৌদ্ধ রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল।
অতঃপর ১৩৪০ খৃস্টাব্দে সোনারগাঁও সুলতান ফখরউদ্দীন মুবারক শাহর (১৩৩৮-১৩৫০খৃ.) সেনাপতি কদল খান গাজী আরাকানিদের বিতাড়িত করে চট্টগ্রামকে সর্বপ্রথম মুসলমান শাসনভুক্ত করেন। (২৭)
তখন থেকে ১৫৮০ খৃস্টাব্দ অবধি চট্টগ্রাম বাংলার স্বাধীন সুলতান ও আফগান শাসনভুক্ত ছিল। তবে আরাকানের ইতিহাস সূত্রে জানা যায় যে, উক্ত সময়ের আরাকানের রাজারা সাময়িককালের জন্য চট্টগ্রাম কখনো সম্পূর্ণ আর কখনো আংশিক অধিকার করে শাসন করেছিলেন।
তারপর ১৫৮০ খৃস্টাব্দে আরাকান রাজ মিনফালং সিকান্দর শাহ (১৫৭১-১৫৯৩ খৃ.) চট্টগ্রামের আফগান শাসক জামাল খান পন্নীকে পরাজিত করে সমগ্র চট্টগ্রাম আরাকান রাজ্যভুক্ত করেন। (২৮)
তখন থেকে ১৬৬৫ খৃস্টাব্দ অবধি চট্টগ্রাম একাক্রমে পঁচাশি বছরকাল আরাকান রাজ্যভুক্ত ছিল। অতঃপর ১৬৬৬ খৃস্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে চট্টগ্রামের বৃহদংশ শংখ নদীর উত্তর তীর অবধি মোঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়, দক্ষিণ চট্টগ্রাম আরাকান রাজ্যভুক্ত থাকে। (২৯)
১৭৫৬ খৃস্টাব্দে আরাকানিদের বিতাড়িত করে শংখ নদীর তীরবর্তী দক্ষিণ চট্টগ্রাম নবাবশাসিত সুবে বাংলাভুক্ত করা হয়। (৩০) এই হলো চট্টগ্রামের প্রাচীন বৌদ্ধ শাসনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
রাম কোট বিহারের প্রধান পুরোহিত বলেন, রাম কোট দুর্গ ও বিহার চট্টগ্রামের সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক স্মারক নিদর্শন। টলেমীর ভূগোলে রামুর বিবরণ পাওয়া যায়। রাম কোট এলাকার বিভিন্ন পাহাড়ে বুদ্ধমূর্তির ধ্বংসাবশেষ থেকে তার প্রাচীনতত্বের অনুমান করা যায়।
কথিত হয় যে ১৪৬ খৃস্টাব্দে রাজা চন্দ্রসূর্য আরাকান-চট্টগ্রামে রাজ্য স্থাপনকালে এখান একটি দুর্গ ও বিহার নির্মাণ করিয়াছিলেন। রাম কোট বিহারের অধ্যক্ষ জগৎ চন্দ্র মহাস্থবির আরো বলেন, রাম কোটে সধাতুক বড় বৌদ্ধবিহার সম্রাট অশোকের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। সম্রাট অশোকের স্থাপিত ৮৪ হাজার ধাতু চৈত্যের একটি এই রামু চৈত্য। সম্রাট অশোকের ধর্মরাজিকা চৈত্য বঙ্গোপসাগরের পূর্ব উপকূলে স্থাপিত হয়। (৩১)
১. জে এ এস বি ১৮৯৮ পৃ. ২১, ২৩
২. ইতিহাস, ঢাকা ১৩৭৫ বাং, পৃ. ১৭০-১৭১
৩. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬২
৪. জেলা পরিষদ-কুমিল্লার ইতিহাস, ১৯৮৪, পৃ. ৯৭
৫. ডক্টর হোদীওয়ালা, স্টাডিজ ইন ইন্ডোমুসলিম হিস্ট্রি, ১৯৩৯, পৃ. ৪
৬. প্রসিডিং অস দ্য হিস্ট্রি কনফারেন্স, করাচি, পাকিস্তান, ১৯৫৯, পৃ. ১৯৮
৭. ইন্ডিয়ান হিস্ট্রিক্যাল কোয়ার্টর্লি, ভল্যুম ১৬ পৃ. ২৩২-২৩৪
৮. (ক) মডার্ন রিভিউ ১৯২২, নবেম্বর, পৃ. ৬১২-৬১৪ (খ) ইন্ডিয়ান হিস্ট্রিক্যাল কোয়ার্টার্লি, ভল্যুম ২, ১৯২৬, পৃ. ৩২২
৯. প্রাগুক্ত, ভল্যুম ১২, ১৯৩৫, পাদটীকা, পৃ. ৭৫
১০. ইতিহাস সমিতি পত্রিকা, ৭/৮ সংখ্যা, ১৩৮৫-১৩৮৬, পৃ. ৭৫
১১. অশোক কে, ভট্টাচার্য ঝিয়রী ব্রোনজ বুদ্ধজ, দেশ; গ্রন্থালোক, দেশ, পৃ. ১৯৯০, ১০ নবেম্বর; ৫৮ বর্ষ, ২য় সংখ্যা
১২. আবদুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রামের ইতিহাস-প্রসঙ্গ, ১৯৮২ পৃ. ১০৯
১৩ (ক) জে এ এস পি ভল্যুম ১, ১৯৬১, পৃ. ৫, ২৬৭-২৭৩ (খ) ইতিহাস, ১৩৭৫, পৃ. ১৭২-১৭৩
১৪. নলিনীকান্ত দাস এম এ পন্ডিতবিহারের তিলপাদ (প্রবন্ধ), শারদীয় পাঞ্চজন্য, চট্টগ্রাম, ১৩৪৫ বাং, পৃ. ১২০-১২১
১৫. জি ই হারভে, আউটলাইন অব বার্মিজ হিস্ট্রি, পৃ. ১৫
১৬. কক্সবাজার ফাউন্ডেশন, কক্সবাজারের ইতিহাস, ১৯৯০, পৃ. ১২
১৭. এশিয়াটিক রিসার্চের, ভল্যুম ২, ১৭৯৪, পৃ. ২৯৯-৩০২
১৮. জার্নাল অব দ্য বুড্ডিস্ট টেক্সট এন্ড রিসার্চ সোসাইটি ভল্যুম, ১৭, ১৯০৫ পৃ. ৫-৬
১৯. জে এ এস বি ভল্যুম, XXI নং ২, আগস্ট ১৯৭৫, পৃ. ৬৩
২০. কক্সবাজার ফাউন্ডেশন, কক্সবাজারের ইতিহাস, পৃ. ১২
২১. জি ই হারভে, আউটলাইন অব বার্মিজ হিস্ট্রি, পৃ. ১৫
২২. প্রাগুক্ত, পৃ. ২১
২৩. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৯
২৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ভল্যুম ২, পৃ. ২৫১-২৫৭
২৫. আবদুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রাম-আরাকান, পৃ. ৪৬
২৬. ড. আহমদ শরীফ, ইতিহাস, ঢাকা, ১৩৭৫ বাং, পৃ. ১৭৯
২৭. ড. আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস সুলতানী আমল, পৃ. ১৮১
২৮. ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো, এ হিস্ট্রি অব চিটাগাং, ভল্যুম ১, পৃ. ২০০
২৯. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ভল্যুম ২, পৃ. ৩৮১
৩০. মাহবুব-উল-আলম, চট্টগ্রামের ইতিহাস নবাবী আমল, পৃ. ৬০
৩১. কক্সবাজার জেলা বর্ষপূর্তি স্মারক পুস্তিকা, মার্চ, ১৯৮৫ সূত্র : আবদুল হক চৌধুরী স্মারক গ্রন্থ; সম্পাদনা – মুহম্মদ মজির উদ্দীন মিয়া, তসিকুল ইসলাম
এই বিষয়ে আরো জানতে পড়ুন – চট্টগ্রামের বৌদ্ধ জাতির ইতিহাস – নূতন চন্দ্র বড়ুয়া
Comments