in

চট্টগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : ঐতিহাসিক যুগ

চট্টগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : ঐতিহাসিক যুগ

চট্টগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : ঐতিহাসিক যুগ – প্রাচীন আমল : প্রাকৃতিক দিক থেকে একই ভূখণ্ডে অবস্থিত, আজকের দুই ভিন্নমুখী সভ্যতা ও সংস্কৃতির অনুসারী বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলা ও বার্মা দেশের আরাকান সুপ্রাচীন কাল থেকে একটি দেশরূপে পরিগণিত হতো। তখন চট্টগ্রাম ও আরাকান আদিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত ছিল। 

আরাকানের প্রাচীন ইতিহাস রাজোয়াং সূত্রে জানা যায় যে, খ্রিষ্টিয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগে চন্দ্রসূর্য নামক মগধের এক সামন্ত (১৪৬ খ্রিষ্টাব্দ) আদিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত ভূখণ্ড চট্টগ্রাম-আরাকান অধিকারকরত সর্বপ্রথম একটি রাজ্য স্থাপন করেন এবং তিনি সেখানকার রাজা হন। তাঁর রাজধানী ছিল আরাকানের ধান্যবতীতে। তাঁর সঙ্গী মগধাগত হিন্দু-বৌদ্ধ সৈন্যরা এই অন্ধকারাচ্ছন্ন রাজ্যের অনুন্নত জড়োপাসক আদিম জনগোষ্ঠীকে সর্বপ্রথম আর্যধর্ম, ভাষা, লিপি ও সংস্কৃতিতে দীক্ষা এবং শিক্ষাদান করে। 

কালক্রমে চট্টগ্রামে হিন্দুধর্ম প্রাধান্য লাভ করে, আরাকানে বৌদ্ধধর্ম প্রবল হয়। খ্রিষ্টিয় পঞ্চম শতক অবধি চট্টগ্রাম-আরাকান একটি অখণ্ড রাজ্যরূপে চন্দ্রসূর্য রাজবংশের রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল। 

ষষ্ঠ শতকে চট্টগ্রাম সমতট রাজ্যভুক্ত হয়। সপ্তম শতক অবধি চট্টগ্রাম সমতটের রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়। অষ্টম শতকে ধর্মপালের রাজত্বকালে চট্টগ্রাম স্বল্পকালের জন্য পাল সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। 

বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওলজি বিভাগের প্রফেসর গৌরিশ্বর ভট্টাচার্য সাম্প্রতিককালে চট্টগ্রাম থেকে সংগৃহীত লিপি পাঠ করে বলেন যে অষ্টম শতকে দেবাতিদেব নামক এক অনার্য বংশীয় খাসা উপজাতির রাজা চট্টগ্রাম অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। নবম শতকে চট্টগ্রাম হরিকেল রাজ্যভুক্ত হয়। হরিকেলের বৌদ্ধ রাজা কান্তিদেবের আমলে বর্ধমানপুরে উৎকীর্ণ তাম্রশাসনখানি আবিষ্কৃত হয়েছিল চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া ‘বড়উডান’ গ্রামের সন্নিকটবর্তী এলাকায়। 

চট্টগ্রামের ইতিহাসের গবেষক ডক্টর সুনীতি ভূষণ কানুনগো বলেন, খ্যাতনামা চৈনিক পরিব্রাজক ইউ-হে বর্ণিত সিংহল থেকে সমুদ্রপথে তিরিশ দিনের পথ ও নালন্দা থেকে একশত যোজন বা আটশত মাইল দূরবর্তী মেঘনা নদীর পূর্ব অববাহিকায় হরিকেল রাজ্য অবস্থিত ছিল। এই রাজ্যের সমুদ্র নিকটবর্তী রাজধানী বর্ধমানপুর পটিয়া থানার বড়উডান, নালন্দার সন্নিকটবর্তী পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান নয়। 

অশিক্ষিত লোকমুখে বর্ধমানপুর বিকৃত ও সংক্ষিপ্ত হয়ে বড়উডান হয়েছে। অষ্টম-নবম শতক থেকে বাণিজ্য উপলক্ষে মুসলমান আরব বণিকরা চট্টগ্রামে আগমন শুরু করে। দশম শতকে চট্টগ্রাম পুনরায় আরাকানের চন্দ্র রাজবংশের অধিকারভুক্ত হয়। ৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানরাজ সুলতইং চন্দ্র নিজ অধিকৃত রাজ্যের উত্তরাংশ চট্টগ্রামের সুরতন বিদ্রোহ দমন করতে এসে বিজয়স্তম্ভে ‘চিৎ-তৌৎ-গৌং’ বাণী উৎকীর্ণ করা থেকে চট্টগ্রাম নামের উদ্ভব হয় । 

দশম শতকে চট্টগ্রামে পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। 

পটিয়া থানার চক্রশালা নিবাসী ধর্মান্তরিত ব্রাহ্মণ সন্তান তিলপাদ বা প্রজ্ঞাভদ্র ছিলেন পণ্ডিতবিহারের অধ্যক্ষ। 

তখন চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্মের মহাযান মতবাদ প্রচলিত ছিল। ত্রয়োদশ শতকের শেষ দিকে ত্রিপুরারাজ চেংথুমফা সর্বপ্রথম স্বল্পকালের জন্য চট্টগ্রাম অধিকার করেন। একাদশ শতাব্দীতে ব্রহ্মদেশের পগারাজ অনরহট (অনিরুদ্ধ বা অনরুদ্ধ, ১০১০-৪৪ খ্রি.) আরাকান, চট্টগ্রাম ও দক্ষিণবঙ্গের এক বিস্তৃত অঞ্চল জয় করেন এবং পার্শ্ববর্তী পাট্টিকেরার রাজাকে করদানে বাধ্য করেন। রাজা অনরহটের মৃত্যুর পর পগা রাজবংশের রাজা সলু, কিয়নজিত্ত্বা (১০৮৪ খ্রি.) ও অলংসিথুর (১১২২-৬৭ খ্রি.) রাজ্যভুক্ত ছিল। 

অলংসিথু পাট্টিকেরার রাজকন্যাকে বিয়ে করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তৎপুত্র নরথু (১১৬৭-৭০ খ্রি.) রাজা হয়ে সেখানকার প্রচলিত প্রথামত বিমাতা পাট্টিকেরার রাজকন্যাকে উপপত্নীরূপে গ্রহণ করেন। কিন্তু অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্নতার জন্য রাজকন্যা তাঁর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করলে তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে তাকে হত্যা করেন। পাট্টিকেরারাজ ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে জল্লাদ পাঠিয়ে পগারাজ নরথুকে হত্যা করে কন্যা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। এই সময় চট্টগ্রাম অল্পকালের জন্য পাট্টিকেরা রাজ্যভুক্ত হয়। 

আরাকানের ইতিহাস রাজোয়াং-এর মতে পারিম বংশের রাজা গৌলিয়াং (১১৩৩ খ্রি.) চট্টগ্রাম অধিকার করেন। এই বংশের পরবর্তী রাজা তাইখিংজেত নেপাল পর্যন্ত অভিযান করেছিলেন। 

চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার রামপুর গ্রামে এবং ১৯৭৮ সালে সীতাকুণ্ড থানার সলিমপুর গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে রাজা দামোদর দেবের আমলে উৎকীর্ণ তিনখানি তাম্রশাসন।

তের শতকের প্রথমার্ধে চট্টগ্রাম সমতটের দেববংশীয় রাজাধিরাজ দামোদর দেবের রাজ্যভুক্ত ছিল।  

এই শতকের মধ্যভাগে আরাকানরাজ অলংফিউ চট্টগ্রামসহ বঙ্গদেশের কিয়দংশ জয় করেন। ত্রয়োদশ শতকের শেষ ভাগে আরাকানরাজ মেংদি তাঁর রাজ্য ব্রহ্মপুত্র তীর অবধি বিস্তার করেন। ইউরোপীয় অভিযাত্রী মার্কোপলোর ভ্রমণকাহিনী থেকে জানা যায়, উক্ত শতকের শেষ দিকে তাতারের খান অল্পকালের জন্য চট্টগ্রাম অধিকার করেছিলেন।  চতুর্দশ শতকের প্রথম দিকে চট্টগ্রাম পুনরায় আরাকান রাজ্যভুক্ত হয় ।

সূত্র : 

বন্দর শহর চট্টগ্রাম – আবদুল হক চৌধুরী ১৯৯৪ (পৃ ১৫-১৬) 

চট্টগ্রামের ইতিকথা – ডক্টর আহমদ শরীফ 

বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি পত্রিকা 

চট্টগ্রামে ইসলাম – ডক্টর আবদুল করিম 

ইনস্ক্রিপশন অফ বেঙ্গল, ভল্যুম ৩ 

What do you think?

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

চট্টগ্রামের ইতিহাস - প্রাগৈতিহাসিক যুগ

চট্টগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : প্রাগৈতিহাসিক যুগ

সুলতানি আমল

চট্টগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : সুলতানি আমল