আরাকানি আমল : ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানরাজ মেং ফালং (সিকান্দর শাহ্ ১৫৭১-৯৩ খ্রি.) চট্টগ্রামের পাঠান শাসনকর্তা জামাল খান পন্নীকে পরাজিত করে চট্টগ্রাম অধিকার করেন। কিন্তু ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ত্রিপুরারাজ অমরমাণিক্য উত্তর চট্টগ্রাম অধিকার করেন এবং সেখানে তাঁর আশ্রিত বারভূঁইয়া-প্রধান ঈশা খাঁ কিছুকাল অবস্থান করেন। তাঁরই স্মারকরূপে উত্তর চট্টগ্রামে ঈশাপুর পরগণার নামকরণ হয়েছে।
সে সময় কোনো কারণে রামু-চকরিয়ার আরাকানি সামন্ত আদমশাহ্ আরাকানরাজের বিরাগভাজন হয়ে অমরমাণিক্যের আশ্রয় গ্রহণ করেন। আরাকানরাজ আদমকে ফেরত চাইলে অমরমাণিক্য আশ্রিতকে ফেরত দিতে অস্বীকার করেন। আরাকানরাজ তাতে রুষ্ট হয়ে ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে দু লক্ষ সৈন্য পাঠিয়ে উত্তর চট্টগ্রাম অধিকার করে ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুর পর্যন্ত লুণ্ঠন করেন। তাতে অপমানিত হয়ে অমরমাণিক্য আত্মহত্যা করেন।
আরাকানরাজ মেং রাজদাগ্যির (সলিমশাহ্ ১৫৯৩-১৬১২ খ্রি.) রাজত্বকালে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন মহাপিনাগ্য। তিনি বৌদ্ধ শাস্ত্রের অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। মহাপিনাগ্য পিয়উন তাঁর রচিত গ্রন্থ। তাঁর মৃত্যুর পর সিনাবাদি নামক একজন আরাকানি সভাসদ চট্টগ্রামের শাসনকর্তা হন। এই সময় পর্তুগিজরা চট্টগ্রামে অত্যন্ত প্রবল হয়। তিনি অত্যন্ত কঠোর হস্তে পর্তুগিজদের দমন করেন। কিন্তু শেষে পুর্তগিজদের সাথে এক সংঘর্ষে তিনি নিহত হন। তখন ‘আনা পুরম’ নামে আরাকানরাজের এক আত্মীয় চট্টগ্রামের শাসনকর্তা হন।
এই সময় সন্দ্বীপ পর্তুগিজ অধিকারে ছিল। ফতে খাঁ সন্দ্বীপ দখল করে সেখানকার পর্তুগিজদের হত্যা করেন। কিন্তু কিছুদিন পর পর্তুগিজ জলদস্যু গঞ্জালিশ ফতে খাঁকে হত্যা করে পুনরায় সন্দ্বীপ অধিকারকরত পাইকারিভাবে লুঠতরাজ রাহাজানি আরম্ভ করে।
১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানের রাজা মেং রাজদাগ্যির মৃত্যুর পর মেংখা মৌ (হোসেন শাহ্ ১৬১২-২২ খ্রি.) আরাকানের রাজা হন। তিনি চট্টগ্রামের শাসনকর্তা (তাঁর ছোট ভাই) আনাপুরম-এর বিশ্বস্ততায় সন্দেহ করে তাঁকে পদচ্যুত করেন। আনাপুরম পর্তুগিজদের সাহায্যে আরাকানরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কিন্তু তিনি যুদ্ধে আহত ও পরাজিত হয়ে বিশ্বস্ত সেনাদলসহ সপরিবারে সন্দ্বীপে গঞ্জালিশের আশ্রয় গ্রহণ করেন। আহত আনাপুরম সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পুত্রকন্যারা খ্রিষ্টধর্মে ৬৮ দীক্ষিত হন।
মেংখা মৌং সন্দ্বীপে অভিযান চালিয়ে পর্তুগিজদের সেখান থেকে উৎখাত করেন। গঞ্জালিশ নিখোঁজ হয়। অতপর তিনি চট্টগ্রাম থেকে পর্তুগিজদের নির্মূল করার জন্য অগ্রসর হন। কিন্তু পাদরি ম্যানরিকের দৌত্যের ফলে চট্টগ্রামের পর্তুগিজরা রক্ষা পায়। এই সময় পাদরি ম্যানরিক পাঁচ বছর কাল পর্তুগিজ বন্দর দেয়াঙ্গে ও আরাকানি শাসনকেন্দ্র রামুতে অবস্থান করেন। ‘তখন থেকে পর্তুগিজরা আরাকানরাজের অনুগত হয়ে যায়।
মেংখা মৌং-এর অধিকৃত চট্টগ্রামে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের (১৬০৫-২৭ খ্রি.) রাজত্বকালে বাংলার মোগল সুবাদার ১৬১৬ এবং ১৬২১ খ্রিষ্টাব্দে দুবার চট্টগ্রাম অভিযান করে ব্যর্থ হন। মেংখা মৌং-এর মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র থিরিথুধম্মা (দ্বিতীয় সলিম শাহ্ ১৬২২-৩৮ খ্রি.) আরাকানের রাজা হন। তাঁর শাসনকালে ১৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামে চাউলের দাম বেড়ে টাকা প্রতি দেড়মণ হওয়ায় এক ভীষণ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে আরাকানের রাজারা মুসলমানি নাম গ্রহণ প্রথা পরিত্যাগ করেন।
থিরিথুধম্মার মৃত্যুর পর শিশুপুত্র মিনসানি ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র আটাশ দিন রাজত্ব করার পর নিহত হন। অতপর নরপদিগ্যি (১৬৩৮-৪৫ খ্রি.), থদোমিস্তার ( ১৬৪৫-৫২ খ্রি.) ও সান্দুথুধম্মা (১৬৫২-৮৪ খ্রি.) আরাকানের রাজা হন।
সান্দুথুধম্মার রাজত্বকালে ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে ভ্রাতৃদ্বন্দ্বে পরাজিত আরাকানে আশ্রয়প্রার্থী শাহ্ সুজা হত্যার বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটেছিল।
আরাকানি শাসনকালেই চট্টগ্রামে বছর গণনায় মঘিসন ও জমি পরিমাপে মঘিকালি প্রচলিত হয়। মঘিসন এখানে এই শতকের চল্লিশ দশক অবধি প্রচলিত ছিল। মঘিকালি আজ অবধি জমি পরিমাপে প্রচলিত আছে। আরাকানি শাসনকালে চট্টগ্রামে বিপুলসংখ্যক অধিবাসী ও বহু জ্ঞানী-গুণী জীবিকা উপলক্ষে আরাকানের রাজধানী ম্রোহং-এ বসবাস করতেন। আরাকানি রাজদরবারে বেশ কয়েকজন চট্টগ্রামী বড়ঠাকুর, মাগনঠাকুর, আশরাফ খাঁ, নবরাজমজলিশ, সৈয়দ মোহাম্মদ প্রমুখ মন্ত্রী পদে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় কবি দৌলতকাজি, মরদন প্রমুখ কবি তাঁদের কাব্য রচনা করেছিলেন।
১. জে. এ. এস. বি., আগষ্ট ১৯৭৬, পৃ. ৭১
২. ডক্টর আহমদ শরীফ, চট্টগ্রামের ইতিহাস, ইতিহাস, ঢাকা ১৩৭৫ বাংলা, পৃ. ৫৭
৩. মাহবুব-উল-আলম, চট্টগ্রামের ইতিহাস: পুরানা আমল, পৃ. ১২৭
৪. ডক্টর সুনীতি ভূষণ কানুনগো, হিস্ট্রি অফ চিটাগাং, পৃ. ২৩৯
৫. জি. ই. হার্ভে, হিস্ট্রি অফ বার্মা, পৃ. ১৪৪-১৪৭
৬. ড. মুহম্মদ এনামুল হক ও সাহিত্য বিশারদ, আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য
Comments