চাটগাঁইয়া ভাষার ইতিকথা ও ভ্রান্ত ধারণার অপনোদনে বিস্তারিত আলোচনা শুরু করার আগে একটু পেছন থেকে আসতে হবে।
২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের মানুষের জন্য গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন হয়েছিলো ফেব্রুয়ারি মাসে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হওয়ার পর পাকিস্তানি শাসকেরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ নিয়ে তালবাহানা শুরু করে দিয়েছিলো। ৬ কোটি ৯০ লাখ জনগোষ্ঠী নিয়ে নবগঠিত পাকিস্তানে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলতো।
অথচ ১৯৪৭ সালে করাচীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের সুপারিশ করা হয় এবং প্রচারমাধ্যম ও বিদ্যালয়ে কেবলমাত্র উর্দু ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়। তখন বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা তাৎক্ষণিকভাবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা ও প্রতিবাদ জানান। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তা একদম আমলে নেননি। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তানি শাসকদের অযৌক্তিক ও লাগামহীন এসব কথা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষেরা মানতে পারেনি। বাংলার মানুষ ভাষা নিয়ে সবসময় সোচ্চার ছিলো। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য পুলিশি হামলাকে উপেক্ষা করে ভাষার দাবীতে রাস্তায় নেমে পড়ে। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ছিলো বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতির চূড়ান্ত দিন। সেদিন ১৪৪ দ্বারা ভঙ্গ করে বাংলা ভাষার জন্য বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বিশ্বে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে। এই ঘটনার পর পাকিস্তানি শাসকরা বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন। ১৯৫৪ সালের ৭ মে মুসলিম লীগের সমর্থনে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। সংবিধানের ২১৪ (১) অধ্যায়ে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে লেখা হয়: The state language of Pakistan shall be Urdu and Bengali.
সারা বিশ্বব্যপী এর আগে কখনো ভাষার জন্য আন্দোলনের কোনো ঘটনা-ই যেখানে ঘটেনি সেখানে বাংলা ভাষার জন্য জীবন দেওয়া একটুখানি কথা নয়। এই দুঃসাহসিক ঘটনার জন্য আজ সারা বিশ্বব্যাপি ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। প্রতিটি মানুষের কাছেই তাই মাতৃভাষা একটি অমূল্য সম্পদ। এই অধিকার কেউ হারাতে চায় না। তাই ভাষা নিয়ে আজকের এই লেখা।
কথামুখ:
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে চট্টগ্রাম ব্যতীত অন্যান্য জেলার লোকজনদের কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। এমনকি কোলকাতার মানুষেরাও নাকি আমাদের চট্টগ্রামের ভাষা নিয়ে হাসি, তামাশা করে। অনেকেই ব্যঙ্গ, বিদ্রুপও করে থাকে। এমনকি এই অঞ্চলের কেউ যখন অন্য জেলায় দীর্ঘদিন যাবৎ বসবাস করে; তখন সেখানে তাকে সহপাঠী, শিক্ষক কিংবা সহকর্মীদের সাথে ভাষা (চাটগাঁইয়া) নিয়ে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। হরহামেশাই নিজের কথ্য ভাষা নিয়ে প্রশ্ন করলে কার ভালো লাগবে? তাও সেই প্রশ্ন যদি আবার নিজের জন্মলগ্ন থেকে যে ভাষায় কথা বলে আসছে সেই কথ্য ভাষা হয়ে থাকে তাহলে স্বাভাবিকভাবে যে কারো খারাপ লাগার কথা। খারাপ লাগা থেকেই তাদের মধ্যে অনেক সময় বাকবিতর্ক পর্যন্ত হয়ে যায়। চট্টগ্রামের বাইরে থাকা মানুষদের সাথে এমন ঘটনাও ঘটে থাকে যে, ঐসব এলাকার মানুষেরা চাটগাঁইয়া মানুষকে খাটো করার জন্য চাটগাঁইয়া ভাষার প্রতি রঙ্গব্যাঙ্গের তীর হামেশাই নিক্ষেপ করেন। এই ধরণের ঘটনা আমাকেও নিস্তার দেয়নি। তাই চাটগাঁইয়া ভাষাভাষী হয়ে সেই কালিমা লেপন মুছে ফেলতে আজকের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। শুরুতেই বলে রাখি ভাষার প্রতি যাঁর বিন্দুমাত্র প্রেম রয়েছে তিনিই বুঝতে পারেন ভাষা বা উপভাষার আলোচনায় কত রকমের হাস্যরস থাকতে পারে। সেই হাস্যরসে ভরা ভাষা বা উপভাষা নিয়ে উপহাস করার অবকাশ কারো বিন্দু পরিমাণও নেই। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলা ভাষার সাথে দেশের সকল উপভাষা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলা ভাষার পুরনো ইতিহাস তা-ই বলে। সেজন্যই চাটগাঁইয়া ভাষা আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ থেকে শুরু করে আস্কর আলী পণ্ডিত, ড. এনামুল হক, ড. মনসুর মূসা, আবুল ফজল, আবদুল হক চৌধুরী, K.P. Gousami প্রমুখদের মতো খ্যাতিনামা বিশেষজ্ঞদের মনযোগ আকর্ষণ করেছে। উল্লেখ্য চট্টগ্রামের ভাষা নিয়ে গবেষণার জন্য ত্রিপুরার বিখ্যাত কবি ও লেখক ড. রবীন্দ্র কুমার দত্ত ১৯৯৮ সালে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
এরপরও যাঁরা ভাষাজ্ঞানহীনদের মতো চাটগাঁইয়া ভাষাকে নিয়ে বিদ্রুপপূর্ণ আচরণ করে থাকে তাঁদের প্রতি আমি সবিনয় নিবেদন করে বলছি, চট্টগ্রামের ভাষা এখনো পূর্ণাঙ্গ একটি ভাষায় রূপ না নিলেও এই ভাষা নিঃসন্দেহে একটি উপভাষা। এই ভাষাকে নিয়ে সঠিকভাবে গবেষণা করলে এই ভাষাকেও পূর্ণাঙ্গ ভাষায় রূপ দেওয়া না গেলেও এটিকে অন্তত একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষার কাছাকাছি দাঁড় করানো সম্ভব। সেই প্রচেষ্টাও অনেক গবেষক, ইতিহাসবিদ, ভাষাবিদ ও সাহিত্যিকরা করে যাচ্ছেন। ইদানীং চট্টগ্রামের ভাষার প্রতি যাদের বিদ্বেষ রয়েছে তাহারা চট্টগ্রামের ভাষাকে ব্যঙ্গ করার পেছনে একটা যুক্তি দেখিয়ে থাকেন। সেটি হচ্ছে বাংলা গদ্যে চলিত রীতির প্রবর্তক প্রমথ চৌধুরী কোনো এক সময় নাকি বলেছিলেন, “বাংলা ভাষা আহত হয়েছে সিলেটে, আর নিহত হয়েছে চট্টগ্রামে”। প্রমথ চৌধুরী কিসের ভিত্তিতে একথা বলেছিলেন তা আমার জানা নেই। সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। যেহেতু তিনি এটি নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেননি, সেক্ষেত্রে উনার মতো বাংলা সাহিত্যে অবদান রাখা একজন মানুষকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করা মানানসই নয়। তবে চট্টগ্রামের ভাষার রয়েছে নিজস্ব বিশাল শব্দভাণ্ডার। এই ভাষা তাই একদম স্বতন্ত্র একটি ভাষা হিসেবে বহু আগেই জনমনে স্বীকৃতি পেয়েছে।
ভাষা, বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ ও বাংলা ভাষা :
অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষও একপ্রকারের প্রাণী। কিন্তু মানুষের বিবেক, বুদ্ধি, জ্ঞান ও মানুষের ভাষার কারণের মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা সত্তার অধিকারী।
ভাষা কি?
ভাষা মানুষের মস্তিষ্কজাত একটি মানসিক ক্ষমতা যা অর্থবাহী বাকসংকেতে রূপায়িত (বাগযন্ত্রের মাধ্যমে ধ্বনিভিত্তিক রূপে বা লৈখিক রূপে) হয়ে মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করতে এবং একই সমাজের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করে।
মানুষের অন্যতম যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। ভাষা কিছুটা মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য আর কিছুটা পরিবেশ নির্ভর। এই বিষয়ে অনেক ভাষাবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও সবাই একটি বিষয়ে একমত যে, স্বাভাবিক মানুষেরা ভাষা অর্জনের মানসিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় এবং কেউ যদি একবার ভাষার মূলসূত্রগুলো আয়ত্ব করে নিতে পারে তবে সারাজীবন মানুষ তার ভাষায় নতুন নতুন বাক্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। এই গুনটি শুধুমাত্র মানুষেরই রয়েছে। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী এই অসীম প্রকাশসম্পন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী না।
কেউ কেউ বলেন খ্রিস্টীয় নবম-দশম শতকে, কারো কারো মতে হাজার-দ্বাদশ শতকের মধ্যে আবার কেউ কেউ বলেন সপ্তম থেকে অষ্টম খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। তবে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর মতে, ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন বলা হয় চর্যাপদকে। এ নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। তবে আপাতত অন্য কোনো তথ্য না থাকাতে এটিই বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন হিসেবে ধরে নিতে হবে। চর্যাপদের ভাষা, শব্দগঠন, উৎপত্তিস্থল, রচয়িতাদের ধর্ম, চাটগাঁইয়া ভাষার সাহিত্য, আরকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের চর্চা প্রভৃতি দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, চর্যাপদ চট্টগ্রামে রচিত হয়েছে এবং রচয়িতাদের অধিকাংশই চট্টগ্রামের। চর্যাপদ কাব্যে চট্টগ্রামের প্রাচীন আঞ্চলিক ভাষা অনুসরণে রচিত।
এখন প্রশ্ন থেকেই যায় যে, চর্যাপদ যদি বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন হয়ে থাকে তাহলে এটি নেপালে গেলো কিভাবে? তাহলে এটি লেখার উৎস কোথায়?
নেপালের পুরানো ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় নেপালের সাথে বৌদ্ধদের একটা সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে বৌদ্ধদের আবির্ভাবের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখা যায় শুরু থেকে চট্টগ্রামে বৌদ্ধদের সামাজিক, রাস্ট্রীয় ও শিক্ষাগত প্রাধান্য ছিলো। খ্রিস্ট্রীয় আনুমানিক অষ্টম শতকে চট্টগ্রামে বৌদ্ধরা উপমহাদেশের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। নবম শতকের শেষভাগে চট্টগ্রামের পট্টিকারার চন্দ্রবংশের রাজাদের শাসনাধীন ছিলো। তখন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চট্টগ্রামে সাহিত্যচর্চা চলতো। তখন ধর্মীয় কারণে এঁদের সাথে নেপালের একটা সুসম্পর্ক ছিলো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চট্টগ্রামে বৌদ্ধদের প্রতিষ্ঠিত পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ রচিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার প্রায় দু’শ বছর পর চট্টগ্রামের পটিয়ার চক্রশালায় একটি বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বৌদ্ধ এই বিহারটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিহারের উদ্দেশ্য ছিলো বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার করা, শিক্ষা দেওয়া ও আঞ্চলিক ভাষার মাধ্যমে মানুষদের সচেতন করা। তখন এখানে অনেক হিন্দুরাও বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ পণ্ডিতগণ যেখান থেকেই আসুক না কেন, এরা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাকে একটি আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। যাহোক এই চক্রশালায় এই পণ্ডিতগণ স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্যচর্চা করা শুরু করেন। পরবর্তীতে এরা এখানকার সাধারণ মানুষদের মুখ থেকে শুনে কবিতা, পদ রচনা করেন। এভাবেই চর্যাপদের সূচনা। অর্থাৎ চর্যাকারগণ চট্টগ্রামের প্রাচীন আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্যকর্ম করতেন। যার প্রভাব এখনো আরকান, বর্মী, নেপাল ও ভারতের বিভিন্ন বঙ্গ সংলগ্ন অঞ্চলে লক্ষণীয়।
এবার চর্যাপদ কিভাবে চট্টগ্রাম থেকে নেপালে গেলো তার সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে। তাহলে আলোচনা করা যাক কিভাবে চর্যাপদ নেপালে গেলো।
পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অধ্যক্ষ হিন্দু ধর্ম থেকে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়ে তিলপাদ থেকে প্রজ্ঞাভদ্র নান ধারণ করেন। এই লোকের জন্ম চট্টগ্রামের পটিয়া চক্রশালায়। মূলত চক্রশালার প্রচরণায় ইনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন।
উনি সংস্কৃতি, পালি ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ছয়টি গ্রন্থ লিখেন। তাঁর জন্মস্থান চট্টগ্রামে হলেও তিনি সবসময় চট্টগ্রামে থাকতেন না। তাঁর লেখা গ্রন্থ অচিন্ত্য মহামুদ্রনাম বইটি “যশঃপালপুরঃ” নাম স্থানে লেখা হয়েছিলো৷ এই স্থানটি চট্টগ্রামে নয় বরং নেপালে বলে অনেকের অভিমত রয়েছে৷ তিনি কোনো এক বিশেষ কারণে নেপালে যান। সেখানে তিনি যাওয়ার সময় পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছু গ্রন্থ নিয়ে যান। এই গ্রন্থ সমূহের মধ্যে চর্যাচর্য বিনিশ্চয় গ্রন্থটিও ছিলো। যা ১৯০৭ সালে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজকীয় গ্রন্থাগার থেকে উদ্ধার করেন।
অষ্টম শতক থেকে বাংলায় রচিত সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডারের মধ্য দিয়ে অষ্টাদশ শতকের শেষে এসে বাংলা ভাষা তার বর্তমান রূপ পরিগ্রহণ করে। চর্যাপদ রচনার মধ্যদিয়ে বাংলা ভাষার আবির্ভাব হয়। তাই চর্যাপদের সাথে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার ওতপ্রোত সম্পর্ক যেহেতু রয়েছে নিঃসন্দেহে বলা যায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বাংলা ভাষার থেকেও আরো প্রাচীন একটি ভাষা।
চট্টগ্রামের ভাষা ও ভাষার ইতিহাস ও ব্যাকরণ বিধি:
চট্টগ্রামের ভাষার পেছনে জঠ খুলতে হলে প্রথমে দেশের প্রচলিত সাধু বা আধুনিক চলিত ভাষার পেছনের ইতিহাস জানতে হবে। আমাদের দেশে বর্তমান প্রচলিত যে সাধু ভাষা বা আধুনিক চলিত ভাষা রয়েছে, তা আমাদের দেশের কোনো অঞ্চল বা জেলার ভাষা নয়।
প্রচলিত এ ভাষাটি মূলত ‘কোলকাতা’ শহর এবং তার পাশে ‘ভাগিরথী নদী তীরবর্তী’ মানুষের মুখের ভাষা। বৃটিশ ভারতে এই অঞ্চলে বিদ্যাসাগরের মাধ্যমে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে এই “সাধু” ভাষা প্রবেশ করে। যদিও তখনো পূর্ববঙ্গে ভাষাটির বিকাশ ঘটেনি। তবে পরবর্তীতে বাংলাদেশের পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর থেকে কোলকাতায় আসা অধিবাসী প্রমথ চৌধুরীর মাধ্যমে কোলকাতা ও ভাগিরথী অঞ্চলের ‘কথ্য ভাষা’ হিসেবে ‘আধুনিক বাংলা’ সাহিত্যে স্থান করে নেয়। তখন যেহেতু কোলকাতা ভারতের রাজধানী ছিল, তাই রাজধানীর প্রভাবশালী এই ভাষাটি কালক্রমে বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা, চিঠিপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে ‘শুদ্ধ’ ভাষা হিসেবে পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গে প্রভাব বিস্তার করে। “উঁচু জাতে ওঠা” ধারণার মানসেই পূর্ব বাংলার মানুষেরা কোলকাতার ভাষাকে অনায়াসে গ্রহণ করে। তখন থেকে পূর্ব বাংলার সাহিত্যেও এই “সাধু” ভাষা “শুদ্ধ” বাংলা হিসেবে মানুষের মনে লালিত হয়।
তবে কোলকাতা ব্যতীত পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার জনসাধারণ এই শুদ্ধ বাংলাকে নিজস্ব ভাষা বলে গ্রহণ করলেও প্রায় সকল অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত হতো। এখনো সেটি প্রচলন রয়েছে। এখনো বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে একেক জেলার মানুষের মুখের ভাষা একেক রকম। বর্তমানে বাংলা ভাষায় প্রায় ২৭ কোটিরও অধিক মানুষ কথা বলে থাকে। (২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী ২৬ কোটি ৫০ লক্ষ)। ২০১৬ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৬ কোটি বাংলাভাষী রয়েছে। এই সংখ্যা আরো বেড়েছে। সাড়ে ছাব্বিশ কোটিও অধিক এই বাংলা ভাষাভাষীর কথ্য ভাষা তফাৎ আছে।
তখন ‘কোলকাতার বাংলা’ ভাষাটি সকল বাঙালি কর্তৃক গ্রহণের নেপথ্যে কাজ করেছিল প্রথমত রাজধানী কোলকাতার আধিপত্য। তাছাড়া তখন শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, পত্র-পত্রিকা ইত্যাদির কেন্দ্রবিন্দুও ছিলো কোলকাতা।
দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরীর মতো প্রভাবশালী শিক্ষিত জমিদারদের বসবাস ছিলো কোলকতায়। বাংলা সাহিত্যকে বিকশিত করতে যেহেতু এঁদের বড় অবদান রয়েছে সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই এই ভাষা নিয়ে ওনাদের চিন্তাভাবনাগুলো বাংলা ভাষায় কিছুটা প্রভাব বিস্তার করে। অর্থাৎ তারাও তাদের মুখের ভাষাটিকে বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে প্রভাব ফেলেছে দারুণভাবে। এক্ষেত্রে যদি ভারতবর্ষের রাজধানী যদি “কোলকাতা” না হয়ে চট্টগ্রাম হতো এবং রবীন্দ্রনাথ বা এই শ্রেণির সাহিত্যিকের জন্ম কোলকাতা না হয়ে যদি চট্টগ্রামে হতো, তবে হয়তো চট্টগ্রামের ভাষাটি আধুনিক বাংলা ‘সাধু’ বা ‘শুদ্ধ’ ভাষা হিসেবে দুই বাংলার সর্বত্র কিছুটা গৃহীত হতো বলে মনে হয়।
বাংলা সাধু ও আধুনিক চলিত ভাষার পেছনের গল্পতো বলা হয়েছে। এবার চট্টগ্রামের পেছনের গল্প নিয়ে আলোচনা করা যাক। চট্টগ্রামের কথ্য ভাষাকে অনেকেই চাটগাঁইয়া ভাষা বলে থাকে। এটি একটি ভাষা। এটি ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠীর উপশাখা বাংলা অসমীয় ভাষার একটি সদস্য। আবার ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠী ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষা পরিবারের সদস্য ইন্দো-ইরানিয় ভাষাসমূহের একটি শাখা। বাংলা ভাষাও ইন্দো-আর্য ভাষা। মাতৃভাষীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলা ভাষা ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষা পরিবারের চতুর্থ ও ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা। চাটগাঁইয়া ভাষার সাথে বাংলা-অসমীয়া ভাষার একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তবে এই চাটগাঁইয়া ভাষাকে বাংলা প্রমিত ভাষা হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। আবার ইন্দো-আর্যের হিন্দি ভাষার সাথে চাটগাঁইয়া ভাষার কিছুটা মিল রয়েছে।
চাটগাঁইয়া ভাষার কোনো দাপ্তরিক স্বীকৃতি না থাকলেও এই ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। প্রায় তের মিলিয়ন বা এক কোটি ত্রিশ লক্ষ মানুষ চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলে। এটি ছিলো ২০০৯ সালের সমীক্ষা। এখন ২০২২ চলছে। অর্থাৎ গত ১৩ বছরে এই সংখ্যা আরো অনেক বেড়েছে।
তবে আরেকটি কথা স্বীকার্য সত্য যে, বর্তমানে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, অন্যান্য ভাষা মানুষদের সাথে তুলনামূলক বেশি মিলন-মিশ্রণ-বিবাহ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, পত্রিকা, বেতার, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের প্রসারে অন্যান্য ভাষা-উপভাষার পরিবর্তনের সাথে সাথে এই উপভাষারও পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। ভাষা সম্পূর্ণ একটি সামাজিক ব্যাপার। সেক্ষেত্রে সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে ভাষা বা উপভাষা পরিবর্তন হবে এটা বিশ্বাসযোগ্য। এছাড়াও মানুষ সামাজিক, অর্থনৈতিক, ঐতিহাসিক কিংবা ভৌগোলিক কারণে উন্নত বসবাসের জন্য স্থানান্তরিত হচ্ছে। মানুষের ভাষা পরিবর্তনের পেছনে এটিও একটি কারণ।
চট্টগ্রামের বর্তমান শিক্ষিত সমাজে একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রকাশ পায়। সেটি হচ্ছে শিক্ষিত অভিভাবকেরা মনে করেন চাটগাঁইয়া ভাষা বিকৃত, বিশ্রী একটি ভাষা। তবে সেটা যে সকল শিক্ষিতদের ধারণা তা না। অল্প কিছু ব্যতিক্রম হতেই পারে। বই পুস্তকে কোথাও এই ভাষা নেই। তাই তাঁরা তাঁদের সন্তানদেরকে এই ভাষা থেকে খুব সচেতনতার সাথে দূরে রাখার চেষ্টা করে। এমনকি অনেকেই সন্তানদের সাধু ভাষা বা বইয়ের ভাষাকে কথ্য ভাষায় অভ্যস্ত করতে তাঁরা সন্তানদের নিয়ে শহরে বসবাস করার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নেন। এই পদক্ষেপ থেকে একেবারে সফলতা যে পাচ্ছেন না তা না। ক্ষনিকের এই সফলতা তখনই হিতের বিপরীত হয়ে দাঁড়াবে যখন তাঁদের সন্তানেরা কোনো এক দুর্ভাগ্যবশতঃ গ্রামে বসবাস শুরু করবে তখন। এবং এই বসবাসের সময় যদি তাঁর নাতিনাতনিদের বেড়ে উঠা যদি গ্রামে হয় তখন এই শিশুগুলো ভাষার জঠে ভুগবে! এমনটা কিন্তু আমাদের চট্টগ্রামের গ্রামীণ সমাজে কিন্তু ঘটছে। এই তো গেলো আত্মক্ষতি; ভাষার ক্ষতি তো আছেই। তা হলো নিরবে এই পদক্ষেপ যে একটা ভাষা বিলুপ্তি করার নেপথ্যে কাজ করছে সেটা কেউ চিন্তা করে না।
ভাষা বা উপভাষা মানব সমাজ, ইতিহাস, সংস্কৃতি ইত্যাদির সাথে যে সম্পৃক্ত তা অনেকেই জানে না। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে অতীতে বিলুপ্ত ভাষা সম্পর্কে তথ্য ঠিকই মিলবে। যেমন চট্টগ্রামের গ্রামীণ সমাজের মানুষেরা এখনো একটি শব্দ ব্যবহার করে থাকেন যেটা এখন শিক্ষিত সমাজে বিলুপ্ত প্রায়। “আতিক্ক্যা” শব্দটি ১৫/২০ বছর আগেও চট্টগ্রামের সবখানে প্রচলিত ছিলো। “আতিক্ক্যা” আ= নয়+তাকান+র্যা অথাৎ যা না তাকানোর পূর্বে ঘটে। এই শব্দের পরিবর্তে এখন ব্যবহৃত হয় “হঠাৎ” শব্দটি। এখন চাটগাঁইয়া ভাষার এরকম আরো অনেক শব্দ অশিক্ষিতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
চট্টগ্রামে সমুদ্র বন্দর থাকাতে ও এটি বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হওয়াতে বহু আগে থেকে ব্যবসায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও প্রসিদ্ধ একটি স্থান হিসেবে এই অঞ্চল পরিচিতি লাভ করে। তখন নদীপথে পণ্য আমদানি রপ্তানি ছিলো একমাত্র মাধ্যম। চট্টগ্রামের ভাষা ও বাণিজ্যিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এই অঞ্চলে বাণিজ্যের লক্ষ্যে আরবী, ফরাসী, ইউরোপ, ইংরেজ প্রভৃতি ভাষাভাষীর লোকেরা এখানে আসেন। তাঁরা এখানে বসতিও স্থাপন করেন। আস্তে আস্তে তাঁদের মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক হয়। এভাবেই এই অঞ্চলের কিছু অংশে মিশ্র জাতীর সৃষ্টি হয়। মিশ্র জাতীর মধ্যে একে অপরের সাথে কথোপকথনের মধ্যে একটি মিশ্র ভাষার আবির্ভাব হয়। এই মিশ্র ভাষাও একসময় চট্টগ্রামের ভাষায় প্রভাব ফেলে।
চাটগাঁইয়া ভাষার মধ্যে ব্যাকারণের প্রয়োগ রয়েছে। তবে বাংলা ব্যাকরণের সাথে চাটগাঁইয়া ভাষার ব্যাকরণগত অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। শুধু শব্দ ভিন্ন হতে পারে। চট্টগ্রামের মানুষরা মনের অজান্তেই তাঁদের কথ্য ভাষার (চাটগাঁইয়া ভাষা) মধ্যে ব্যাকরণের প্রয়োগ করে বাক্য গঠন করে থাকেন। তাঁর কিছু উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টা করছি।
বিদেশি ভাষা থেকে চাটগাঁইয়া ভাষায় অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি শব্দ:
বর্মী = ছামমান(ছোট দ্রুতগামী নৌকা)
আরকান = ছা(বাচ্চা)
আরবি = হয়রান থেকে চাটগাঁইয়া শব্দ হরান যার বাংলা অর্থ ক্লান্ত
পর্তুগীজ = আনানশ থেকে আনারশ
চাটগাঁইয়া ভাষায় বাক্যের ব্যবহারগত প্রয়োগবিধিতে বিভিন্ন বাক্যের গঠনগত রূপ:
চাটগাঁইয়া ভাষায় বাক্য গঠনে চার রকমের বাচ্যভেদ দেখা যায়। যথাঃ কর্মবাচ্য, কর্তৃবাচ্য, ভাববাচ্য ও কর্ম-কর্তৃবাচ্য।
কর্মবাচ্য- আই যাইয়ুম (আমি যাবো)
কর্তৃবাচ্য- ইতারে দেহা জার (তাকে দেখা যাচ্ছে)
ভাববাচ্য- তোয়ার জওন নইল/তোয়ার জা নমই (তোমার যাওয়া হলো না)
কর্ম-কর্তৃবাচ্য- হরগান ছিরি গেইয়ই (কাপড়টা ছিঁড়ে গেছে)
আলোচ্য বাক্যগুলোকে অর্থগত দিক থেকেও নিম্নোক্ত শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন:
নির্দেশাত্মক বাক্য- (অস্তর্থক) আরা আজিয়া আইশ্যি (আমরা আজকে এসেছি)
(নাস্তর্থক) আই ন ফাইরগম/ আই ফাইরতান ন (আমি পারবো না)
প্রার্থনাত্মক বাক্য- আল্লা অনর ভালা গরক (আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুক)
বিষ্ময়াত্মক বাক্য- আহারে, ভালা মানুষ্যা কেন গরি মরি গেইলগই! (আহারে, ভালো মানুষটা কিভাবে মারা গেলো)
সন্দেহাত্মক বাক্য- তোয়ার ফোয়ারে আজিয়ে আর শেশ দেহা ফনলার (তোমার সাথে বোধই আজকে আমার শেষ দেখা)
প্রশ্নাত্মক বাক্য- তোয়ারে এ হথা হনে হইয়েদে? (তোমাকে এই কথা কে বলেছে?)
চট্টগ্রামের কিছু সমার্থক শব্দ:
সমুদ্র = শাগর, দইজ্যা
বুড়ো, প্রবীণ = বুইজ্যা
খড়ের গাদা/পালা = কুইজ্যা (একটি হাসির প্রবাদ আছে। বুইজ্যা কুইজ্যাতুন (গাদা থেকে) ডইজ্জাই ডইজ্জাই (ডিগবাজি খেয়ে) দইজ্যাত (সমুদ্রে) ফইজ্জই। মানে হচ্ছে বুড়ো মানুষ খড়ের গাদা থেকে ডিগবাজি খেয়ে সমুদ্রে পড়ে গেলো)
রোগ = অসুখ
মাটি = মেডি
পিপড়া = পিয়ারা
তৃষ্ণা = তুরাশ
কলসি = ঘরা
কোমড় = কেইল
কিছু ভিন্নার্থক শব্দ:
যে গরু এখনো বাচ্চা দেয়নি = দঅরা
বাঁশ ও পাতা দ্বারা নির্মিত বিশেষ ছাতা = জউইর
গাছ কাটার কোড়াল = কুরইল
ট্রাক্টর = টেট্টার
পুকুর = ফঅইর
বালিশ = বালুশ
সন্ধ্যাকাল = আজুইন্যা
ভোরে = ফজরত
দুপুরে = দুইরগা
রাত্রে = রাতিয়া
রান্নাঘর = বসহানা
মেহমান এসেছে = গরবা আইস্যে
জলাশয়ের গর্ত = কুয়া
হাতি = আতি
মহিষ = মইশ
নারী = মইয়াফুয়া
ছেলে = মরতফুয়া
সংস্কৃত ও গ্রীক ভাষায় যদিও তিনরকম বচনের ব্যবহার দেখা যায়। যথাঃ একবচন, বহুবচন ও দ্বিবচন। তবে বাংলা, হিন্দি ভাষার মতো চট্টগ্রামের ভাষার মধ্যেও দুই রকমের বচন দেখা যায়। যথাঃ একবচন ও বহুবচন। মানুষ শব্দটি দিয়ে উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
কারক – একবচন- বহুবচন
কর্তৃ- মানুশ – মানুশগুন
কর্ম- মানুশরে – মানুশগুনরে
করণ- মানুশরেদি – মানুষগুরেদি
সম্প্রদান- মানুশরলাই – মানুশগুনরলাই
অপাদান- মানুশরতুন – মানুশগুনত্তুন
সম্বন্ধ- মাইনশর – মানুশগুনর
অধিকরণ- মাইনশততে – মানুষগুনর মইদদে
চট্টগ্রামের ভাষার মধ্যেও লিঙ্গের ব্যবহার রয়েছে। যেমন:
উভয় লিঙ্গ – পুরুষলিঙ্গ – স্ত্রী লিঙ্গ
মানুষ – মরত ফোয়া (ছেলে) – মাইয়া ফোয়া (মেয়ে)
গরু – বিরিশ (পুরুষ গরু) – গাই গরু (মেয়ে গরু)
কুরা (মুরগী) – রাতা কুরা (মোরগ) – কুরি কুরা (মুরগী)
হইতর (কবুতর) – নর – ফারই
“ই” যোগে স্ত্রীলিঙ্গ গঠন। যেমন:
পুরুষ – স্ত্রী
নানা (মায়ের বাবা) – নানি (মায়ের মা)
বুরা (বৃদ্ধ) – বুরি (বৃদ্ধা)
দাদা (বাবার বাবা – দাদি (বাবার মা)
কাকা (বাবার বড় ভাই) – কাকি (বাবার ভাইয়ের বউ)
অউর (শ্বশুর) – অড়রি (শ্বাশুড়ি)
চাটগাঁইয়া ভাষায় অপশব্দের ব্যবহার দেখা যায়। ৪২০ শব্দটির ব্যবহার চট্টগ্রামের ভাষায় ব্যবহৃত হয়। যেমনঃ তোয়ার নান ফোটটোয়েন্টি ফোয়া আই আর বাফর জন্মত ন দেহি (তোমার মতো ফোর টোয়েন্টি ছেলে আমি বাপের জন্মেও দিখিনি।)
বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী হিন্দু মুসলমানরা যেমন ভিন্ন ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করে তেমনি চাটগাঁইয়া ভাষাতেও হিন্দু মুসলমানদের শব্দ ব্যবহারে ভিন্নতা দেখা যায়।
বাংলা ভাষা – মুসলমান চাটগাঁইয়া – হিন্দু চাটগাঁইয়া
জামা – কোততা – কাপড় (হর)
থালা – বততন – থাল
কলশি – ঘরা – কলশ
গ্লাশ – গলস – গেলাশ
অতীতে বাংলার সীমানা আরকান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। চট্টগ্রামে মোগল শাসন শুরু হয় ১৬৬৬ খ্রীস্টাব্দে এবং ইংরেজ শাসন শুরু হয় ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে। প্রাচীন কাল থেকেই চট্টগ্রাম দু’টি অংশে ভাগ ছিলো। একটি পশ্চিমাঞ্চল এবং অপরটি পূর্বাঞ্চল। পশ্চিমাঞ্চলে মুসলমান, হিন্দু ও বৌদ্ধদের অধ্যুষিত অঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চল ছিলো মোঙ্গলীয় বংশের উপজাতির নিবাস। পূর্বাঞ্চল অনগ্রসরতার অযুহাতে ইংরেজ শাসনামলে এই অঞ্চলকে পৃথক করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা আর পশ্চিমাঞ্চলকে চট্টগ্রাম জেলা হিসেবে গঠন করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রশাসনিক সুবিধার্থে বৃহত্তর চট্টগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রামকে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এ তিনটি জেলায় ভাগ করা হয়। এবং চট্টগ্রামকে দুটি জেলা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় ভাগ করা হয়।
“একদা এক ভারতীয় (কলিকাতা) ভদ্রলোক দু’জন বাঙালির মধ্যে তাঁদের আঞ্চলিক ভাষায় কথোপকথন দেখে খুব অবাক হলেন। তিনি ব্যক্তিদ্বয়কে বললেন, এই ভাষার অনুবাদ করে তাঁকে বুঝিয়ে দিতে। তাঁহারাও ভদ্রতার সহিত ব্যাখ্যা সহকারে বুঝিয়ে বললেন। এরপর ভারতীয় লোকটি তো আরো অবাক হলেন। তিনি বললেন, বাহ্! বেশ চমৎকার ভাষা তো। ইংরেজিতে শর্ট হ্যান্ড (Short hand) আছে; কিন্তু শর্ট মাউথ (Short mouth) আজ-অব্দি বেরোয়নি। এক্ষেত্রে চাটগাঁইয়ারা ইংরেজদের থেকে এগিয়ে আছে। চাটগাঁইয়ারা শর্ট মাউথ (Short mouth) বের করে ফেলে, আবার এর সাহায্যেই বাংলা বলে থাকেন। ভাই, একটু এই ভাষা শেখাতে পারো? এর সাহায্যে কোলকাতায় একটু মজা দেখানো যাবে”। (চট্টগ্রামী উপভাষার একজন সনামধন্য গবেষণা ড. এনামুল হকের উক্তি)
পরিশেষ:
পরিশেষে ইতিহাস ও ভাষার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে চট্টগ্রামের ভাষাশৈলী একটি অসাধারণ ভাষা। তবে সবকিছুর উর্ধ্বে আমরা বাংলাদেশের মানুষ। আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা। ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রামের অনেক বিশিষ্টজনেররাও অংশগ্রহণ করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সাহসী কলম সৈনিকদের মধ্যে অন্যতম একজন হচ্ছেন চট্টগ্রামের মাহবুব উল আলম চৌধুরী। তিনি একুশের প্রথম কবি হিসেবে সুপরিচিত। তাই ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একটা সম্প্রীতির দেশ গড়তে আমাদের মন থেকে ভাষা নিয়ে এসব অহমিকা দূর করতে হবে।
পাদটীকা, সহায়ক গ্রন্থ ও অনলাইন তথ্যসূত্র:
১. নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের উপভাষা- রবীন্দ্র কুমার দত্ত।
২. চট্টগ্রামী বাংলার রহস্যভেদ- ড. এনামুল হক।
৩. চট্টগ্রামের উপভাষা সাহিত্য ও অন্যান্য প্রসঙ্গ- আবুল ফজল।
৪. ইসলামাবাদ ১৯৬৪- আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ।
৫. নিবন্ধ দৈনিক ইনকিলাব থেকে “চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাতেই চর্যাদপ রচিত”- ড. মোহাম্মদ আমীন।
৬. মাতৃভাষীর সংখ্যা অনুসারে ভাষাসমূহের তালিকা
৭. ভাষা
৮. বাংলা ভাষা
৯. প্রমথ চৌধুরী
১০.রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১১. চাঁটগাঁইয়া ভাষা
১২. ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহ
১৩. গৌতম বুদ্ধ
- লেখাটি পাঠিয়েছেন তামজিদ তাহসিন
Comments