চাটগাঁইয়া ভাষা বা সিটাইঙ্গা ভাষা হল ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠির একটি সদস্য ভাষা এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান ভাষা। এটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের ইন্দো-আর্য শাখার পূর্বাঞ্চলীয় উপশাখা বাংলা-অসমীয়া পরিবারের সদস্য। সমগোত্রীয় অন্যান্য ভাষাসমূহ হল বাংলা, অসমীয়া, ওড়িয়া, রোহিঙ্গা, চাকমা এবং বিহারি ভাষা। অন্যান্য বাংলা-অসমীয়া গোত্রের ভাষাসমূহের মত চাটগাঁইয়া পালি ভাষা থেকে এসেছে যা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের একটি কল্পিত পূর্বসূরী।
বাংলা ভাষার সাথে চাটগাঁইয়ার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ বিদ্যমান থাকায় একে প্রায়ই প্রমিত বাংলার উপভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যদিও ভাষাদ্বয় পারস্পরিক একই অর্থে বোধগম্য হয় না অর্থাৎ ভাষাদ্বয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক বিদ্যমান। বাংলার সাথে চাটগাঁইয়া ভাষার প্রায় ৭০ ভাগই মিলে না। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বাংলা থেকে অসমীয়া ভাষার দুরত্ব যতটুকু, চাটগাঁইয়া ভাষা তার চেয়েও অধিক দুরত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম। স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে চাটগাঁইয়া’র রয়েছে নিজস্ব ISO কোড। গ্লোটোলগ, লিঙ্গুয়াস্ফেরার মতো গবেষণকারী সংস্থা চাটগাঁইয়াকে ভাষা হিসেবেই তালিকাভুক্ত করেছে, উপভাষা নয়।
এছাড়াও ভাষা বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান চাটগাঁইয়া ভাষাকে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবেই দেখে। বাংলাদেশে ১ কোটি ৩০ লাখ (মতান্তরে ২ কোটি) মানুষ চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলে। ২০২০ সালে কানাডাভিত্তিক ওয়েবসাইট ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্টে প্রকাশিত বিশ্বের ১০০টি বহুল ব্যবহৃত ভাষার তালিকায় স্থান পায় চাটগাঁইয়া ভাষা। যেটি ১ কোটি ৩০ লাখ ভাষাভাষী নিয়ে পৃথিবীর ৮৮ তম বৃহত্তম ভাষা ও বাংলাদেশে ভাষার দিক দিয়ে বাংলার পরে ২য় বৃহত্তম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। অপরদিকে এথনোলগ নামক সংস্থার জরিপে বিশ্বে বহুল ব্যবহৃত ভাষার তালিকায় চাটগাঁইয়া ভাষার অবস্থান ৭৫ তম। অতীতে এই ভাষা লেখা হতো পার্সো-এরাবিক লিপিতে, যদিও কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে গিয়েছ। বর্তমানে চাটগাঁইয়া ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালা প্রচলিত না থাকায় বাংলা অক্ষরে এ ভাষা লিখতে বেশ বিড়ম্বনার স্বীকার হতে হয় ভাষাভাষীদের। তারপরও চাটগাঁইয়া ভাষাভাষীরা নিজেদের মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখতে প্রায়ই বাংলা অক্ষরে এ ভাষা লিখে থাকেন সামাজিক মাধ্যমগুলোতে।
ভাষাভাষী অঞ্চল: বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল তথা বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষ চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলে। এটি চট্টগ্রাম জেলা এবং কক্সবাজার জেলার প্রধান ভাষা। এছাড়া রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলার ৪৫ শতাংশ মানুষ চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষও আন্তঃসম্প্রদায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে এ ভাষা ব্যবহার করে।
ব্যাকরণ: চাটগাঁইয়া ভাষায় ব্যাকরণে বাংলা ভাষার সাথে কিছু সাদৃশ্য আছে, তবে উপসর্গ, অনুসর্গ এবং অন্যান্য উপায়ে শব্দের কলেবর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বেশ বৈচিত্র্য রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এ ভাষার ব্যকরণের সাথে অসমীয়া ভাষার ব্যকরণের মিল পাওয়া যায়।
বাংলায় সাধারণত না বোধক অব্যয় ক্রিয়ার পরে বসলেও চাটগাঁইয়াতে না বোধক অব্যয় বসে ক্রিয়ার আগে। বাংলার “আমি যাবো না” বাক্যটি চাটগাঁইয়াতে হয় “আঁই ন যাইয়ুম”।
শব্দভান্ডার: চাটগাঁইয়া ভাষার শব্দভান্ডার মূলত সংস্কৃত থেকে আসলেও এই ভাষায় প্রচুর পরিমাণে আরবী, ফারসী, তুর্কি, ইংরেজী, পর্তুগিজ শব্দ রয়েছে। চাটগাঁইয়া ভাষায় এইসব বিদেশী ভাষা থেকে আগত শব্দের পরিমাণ এবং প্রভাব বাংলার চেয়ে বেশী, এবং চাটগাঁইয়াতে সংস্কৃতের প্রভাব অন্যান্য ভারতীয় ভাষার চেয়ে অনেকটা কম।
স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য: বাংলা এবং পার্শ্ববর্তী অন্যান্য ভাষায় মহাপ্রাণ ধ্বনি থাকলেও চাটগাঁইয়া ভাষায় মহাপ্রাণ ধ্বনি একেবারেই অনুপস্থিত।
চাটগাঁইয়ার সাথে বাংলার আরেকটি বড় পার্থক্য হচ্ছে বাংলা বর্ণনাত্মক ভাষা, চাটগাঁইয়া টোনাল বা স্বরনির্ভর । অর্থাৎ কথা বলার সময় স্বরের উঠানামা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চাটগাঁইয়ার ক্ষেত্রে। টোন তথা স্বরের সামান্য পরিবর্তন হলে অর্থ পরিবর্তিত হয়ে যায়। এ ধরণের বৈশিষ্ট্য বাংলায় অনুপস্থিত। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে “ফইর” শব্দটা। এটি চাটগাঁইয়া ভাষায় তিনটা অর্থ প্রকাশ করে। যদি স্বাভাবিকভাবে উচ্চারিত হয় তখন সেটির অর্থ হয় “পালক”। যদি ‘ফ’ তে জোর দিয়ে উচ্চারিত হয় তখন সেটি ”ভিক্ষুক” অর্থ প্রকাশ করে। আবার যদি ‘ই’ কে দীর্ঘ উচ্চারণ করা হয়, তখন তার অর্থ হয় “পুকুর”।
চাটগাঁইয়া প্রবাদ-প্রবচনগুলো বাংলার চেয়ে ভিন্ন।
যেমন ধরেন, ‘ফুঁদত নাই ত্যানা, মিডা দি ভাত হানা।’ – (পাছায় কাপড় নেই তাও মিঠাই দিয়ে ভাত খেতে চায়।)
‘ঘরর গরুএ ঘাডার খের নহায়।’ – (বাড়ির গরু সামনের ঘাস খায় না।)
“নঅয়দে গরুএ দঅরা সা বিয়ায়।” -(যে গরু হবে না সে ছেলে বাছুর দেয়।)
এছাড়াও চাটগাঁইয়া ভাষায় এমন কিছু শব্দ আছে যা পৃথিবীর কোনো ভাষাতেই ভাষান্তর করা সম্ভব না।
যেমন, অবাইজ্জাহোদা, ম্যাইল্লাইফিরা, অত্তারমারেবাপ, ওম্মারেম্মা সহ এ জাতীয় আরো অনেক।
ভাষা চর্চার ইতিহাস: চাটগাঁইয়া ভাষা নিয়ে গবেষণা বা আলোচনা নতুন কিছু নয়। যখন বাংলা ভাষাতত্ত্ব চর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়নি তখনই গ্রীয়ার্সন, লক্ষন মজুমদার, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, আবদুর রশিদ ছিদ্দিকীরা চাটগাঁইয়া নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু নানা কারণে শেষ পর্যন্ত তা আর বাস্তবে রূপ পায়নি।
আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ১৯১৯ সালে প্রকাশিত তার ‘ইসলামাবাদ’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, ‘(বাংলা) লিখিত ভাষার সহিত উহার (চাটগাঁইয়া) বৈষম্য খুবই বেশী- এত বেশী যে চেষ্টা করিলে অসমীদের (অসমীয়া) মত আমরাও অনায়াসে একটা পৃথক ভাষার সৃষ্টি করিতে পারিতাম। কিংবা বহু বিষয়ে সাদৃশ্য থাকিলেও চট্টগ্রামের ভাষা ঠিক পূর্ববঙ্গের ভাষা নহে। তবে নোয়াখালী ও ত্রিপুরার ভাষার সহিত ইহার অল্পকিছু সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। এটি একটি পৃথক ভাষার সকল বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে আছে; একটি (তথাকথিত) উপভাষা হয়েও বহিঃপৃথিবীর সাথে এর সংস্রব ও সংযোগ এর ধ্বনি ও ব্যাকরণের বহু এলাকাকে উন্নীত ও প্রসারিত করেছে এবং ইহার মত সমৃদ্ধশালিনী ও সর্বাঙ্গসম্পূর্ণা ভাষা বাঙ্গালার অন্যত্র খুব কমই মিলিবে।’
চট্টগ্রামের ভাষা ঠিক পূর্ববঙ্গে’র ভাষা নয়। অর্থাৎ ধ্বনি প্রকরণে ও ব্যাকরণে চট্টগ্রামের ভাষা পূর্ববঙ্গীয় উপভাষা সমূহের সমশ্রেণীর ভাষা নয়।’ এ দাবির পক্ষে সাহিত্য বিশারদ ব্রিটিশ পণ্ডিত গ্রীয়ার্সনকে স্মরণ করে বলেছেন, ‘বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত মি. গ্রীয়ার্সনও যে ভাষার নিখুঁত উচ্চারণ লিপিবদ্ধ করিতে পারেন নাই, সে ভাষার নিখুঁত উচ্চারণ লিখিয়া প্রকাশ করা যে অত্যন্ত দুরূহ বিবেচিত হইবে, তাহাতে আর বৈচিত্র্য কিছুই নাই।’ তাহলে দেখা যাক গ্রীয়ার্সন কি বলেছিলেন? গ্রীয়ার্সন তার ১৯০৩ সালে প্রকাশিত ‘লিঙ্গুয়েস্টিক সার্ভে অব ইণ্ডিয়া’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘বাংলা থেকে অসমীয়া ভাষার দূরত্ব যতখানি, চট্টগ্রামের বুলির স্বাতন্ত্র্য তদপেক্ষা দূরত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম।’
শুধু গ্রীয়ার্সন নয়, বাংলাভাষী বহু পণ্ডিত চাটগাঁইয়ার স্বাতন্ত্র্য স্বীকার, মৌন স্বীকার করেছেন। গদ্যকার প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষা আহত হয়েছে সিলেটে, আর নিহত হয়েছে চট্টগ্রামে।’ তার এ বক্তব্যই প্রমাণ করে চাটগাঁইয়া ভাষা বাংলা নয়। কারণ নিহত হওয়া মানে অন্যপারে চলে যাওয়া। বাংলার কাছাকাছি হলেও বাস্তবে চাটগাঁইয়া অন্যপারেরই ভাষা। বোদ্ধা এবং সহৃদয় বাংলাভাষী মাত্রই এ সত্য স্বীকার করবেন।
সম্প্রতি জার্মান গবেষক ড. হান ও ফিনল্যাণ্ডের ফোকলোর গবেষক ড. ভেলাইটি চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডারী গান নিয়ে গবেষণা করেছেন। এ সময় চট্টগ্রামের সাহিত্যিক মহলের বিভিন্ন ঘরোয়া আলাপে তারা বলেছেন, ‘চাটগাঁইয়া সম্পূর্ণ আলাদা একটা ভাষা, এটি প্রচলিত বাংলা ভাষার অন্তর্ভুক্ত নয়।’ কবি বুদ্ধদেব বসু’র মুখের বোল ফুটেছে পিতার কর্মক্ষেত্র নোয়াখালীতে। সেখানেই তাঁর বেড়ে উঠা। অবাক করা ব্যাপার তিনি নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষাকে অনুধাবন করেছেন। এ অঞ্চলের ভাষার মাধুর্য নিয়ে তিনি তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন- ‘আর কোথাও শুনিনি ঐ ডাক, ঐ ভাষা, ঐ উচ্চারণের ভঙ্গি। বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের ভাষা বৈশিষ্ট্য সত্যিই বিস্ময়কর। চাটগাঁর যেটা খাঁটি ভাষা, তাকে তো বাংলাই বলা যায় না।’
ভাষাবিদ ড. মনিরুজ্জামান তার ‘উপভাষা চর্চার ভূমিকা’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘চাটগাঁইয়ার অক্ষর-ঝোঁক, হ-উহ্যতা এবং আন্তঃস্বরীয় ব্যঞ্জন ধ্বনির লোপ বা দ্বিত্বতা ও তৎসহ শব্দগঠনে সংকোচন সংক্ষেপন প্রবণতাই বাঙলাদেশের অপরাপর উপভাষা থেকে একে পৃথক করেছে।
বাংলা ভাষার উপভাষাগুলির মধ্যে সিলেট, নোয়াখালী ও চাঁটগার উপভাষা কিছু স্বাতন্ত্রের অধিকারী। সিলেটি ভাষা ‘টানের’ দিক থেকে, নোয়াখালি দ্রুততার দিক থেকে ও চট্টগ্রামের ভাষা স্বরধ্বনি বহুলতা ও শব্দ সংকোচন বা সংক্ষেপিকরণের দিক থেকে আবার ভিন্ন।’ সাহিত্যবিশারদের মতে, চট্টগ্রামী একটি মিশ্রভাষা। তবে গ্রীয়ার্সন, মুনীর চৌধুরী এবং আরও অনেকে এই দূরপ্রান্তীয় অঞ্চলের ভাষাকে দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের বিভাষা রূপেই দেখেছেন। তথাপি সাধারণ পরিচয়ের জন্য অনেকেই ‘পূর্ববঙ্গীয় উপভাষার’ সাথেই দূরবর্তী সম্পর্কে সম্পর্কিত করে দেখেছেন চাটগাঁইয়াকে। মনসুর মুসা এ দূরবর্তী সর্ম্পককে সমর্থন করে বলেছেন- ‘বাংলাভাষার সবচেয়ে দূরবর্তী উপভাষাটিই চাটগাঁইয়া।’ আর এ দূরবর্তী সম্পর্কের তৈরির পেছনে কাজ করছে রাষ্ট্র কাঠামো। যদি চাটগাঁইয়া ভাষা বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যে না হতো, অথবা বাংলা ভাষা বাংলাদেশের প্রধান ভাষা না হতো তবে ভাষাতাত্ত্বিকরা হয়তোবা এ দূরবর্তী সম্পর্কটি পাততে যেতেন না।
এ ব্যাপারে ড. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘চাটগাঁইয়াকে পৃথক শ্রেণীভুক্ত করার যুক্তি এই ভাষার মধ্যেই নিহিত: ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে পূর্ববঙ্গীয় উপভাষা থেকে তার পার্থক্যটি স্পষ্ট।’ চাটগাঁইয়া’র দূর্ভাগ্য এখানে যে, বাংলাভাষী পণ্ডিতরা যেভাবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার সাধনা করেছেন তা চাটগাঁইয়ারা করেননি। আর বাংলা ও চাটগাঁইয়াভাষী পণ্ডিতদের যথাযথ আগ্রহ বা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা কোনটিই পায়নি চাটগাঁইয়া ভাষা।
সবচেয়ে স্পষ্ট মতামত দিয়েছেন ভাষাবিদ শিশির ভট্টাচার্য্য। তিনি বলেছেন, ‘চাটগাঁইয়া উপভাষা ও বাংলার মান্য উপভাষার মধ্যে ব্যাকরণগত এবং শব্দকোষগত মিল থাকলেও উভয় উপভাষার উৎপত্তি চর্যাপদের যুগ বা পরবর্তি কোন যুগে প্রচলিত আলাদা দু’টি উপভাষা বা অপভ্রংশ থেকে। পুরাকালের সেই দু’টি উপভাষা বা অপভ্রংশের মধ্যে শব্দকোষগত ও ব্যাকরণগত মিলের কারণেই আজকের মান বাংলা আর চাটগাঁইয়ার মিল।’
স্বতন্ত্রতার স্বপক্ষে যুক্তি: প্রথমে ব্যাকরণগত কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা যাক। বাংলা ভাষায় বিরল কিন্তু চাটগাঁইয়াতে প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর কিছু উদাহারণ হচ্ছে- উচ্চারণ বৈচিত্র্য, শব্দার্থ বৈচিত্র্য, শব্দাবয়ব সংক্ষেপন পদ্ধতি ও শব্দ যোজন রীতি।
উচ্চারণ বৈচিত্র্য: সপ্তমি বিভক্তিযুক্ত ও অসমাপিকা ক্রিয়ার ‘এ-কার’ লোপ পেয়ে শেষের বর্ণটি হসন্তযুক্ত হয়। শব্দের শুরুতে শ, ষ, স থাকলে অনেক সময় ‘হ’ বর্ণে রূপান্তরিত এবং একই শব্দ উচ্চারণের দীর্ঘ-হ্রস্বের কারণে অর্থ পাল্টে যায়।
শব্দার্থ বৈচিত্র্য: বাংলা মান ভাষায় ব্যবহৃত একই শব্দ চাটগাঁইয়াতে এসে ভিন্ন অর্থ তৈরি, কোন বিশিষ্ট দীর্ঘভাবকে সুন্দরভাবে এক বা অল্পকথায় প্রকাশ করার অপরিসীম ক্ষমতা এবং প্রতিশব্দের আধিক্য ইত্যাদি।
শব্দাবয়ব সংক্ষেপণ: ঐতিহাসিক নানা কারণে চট্টগ্রামবাসীর উচ্চারণ-ত্রস্ততায় অর্জিত গুনে বাংলা ভাষার দীর্ঘ বাংলা শব্দের সংক্ষিপ্ত অবয়ব বা শব্দায়ব সংক্ষেপ পদ্ধতি। চাটগাঁইয়াতে শব্দের মধ্যস্থিত ‘ব’ লোপ পায় (রবিবার-রইবার) ও ‘ম’ আনুনাসিক চন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
শব্দযোজন রীতি: বাংলাদেশের অন্যান্য আঞ্চলিক বা উপভাষার মত পরম্মুখ না হয়ে চাটগাঁইয়াতে অনেক শব্দ মিলে এক শব্দ হয়ে যায়। এছাড়া উর্দু ও হিন্দির মত ঋণাত্বক পদ ক্রিয়ার পরে না বসে আগে বসাটিও বাংলার উপভাষা না হয়ে একটি স্বতন্ত্র ভাষা হওয়ার লক্ষন।
উচ্চারণ সহজীকরণ তথা সংক্ষেপণ চাটগাঁইয়াতে একটা সহজাত প্রবৃত্তি। কিছু কিছু পণ্ডিত এটাকে উচ্চারণের কোমলীকরণ বলেও মত দিয়েছেন। এছাড়া পদমধ্যবর্তী ব্যঞ্জনবর্ণ প্রায়ই লোপ বা বিকৃত (কোমল) হয়। পূর্ণবিকৃতিও কম নয়। ধ্বনিতত্ত্বে ঘোষ মহাপ্রাণ বর্ণ ‘ঘ’, ‘ধ’, ‘ভ’ প্রভৃতি এবং আদি ‘হ’ রতি আছে। রূপতত্ত্ব একবচনে ‘র’, অধিকরণের এক বচনে ‘ত’ বিভক্তি (বাড়িতে-বাড়িত্)। নিষেধার্থক অব্যয় ‘ন’ ক্রিয়ার আগে (গেল না- ন গেল্) বসে। চট্টগ্রামীতে ক ও খ, প ও দ উচ্চারণে একটু বৈচিত্র্য আছে। ক খ-এর মতো এবং প ফ-এর মতো উচ্চারিত হয় কিন্তু তেমন জোর পড়ে না। অনেক সময় ‘র’ কে ‘ল’ উচ্চারণ করা হয়।
বাংলাভাষীরা প্রায়শই বর্ণমালার অভাবকে দিয়েই ঘায়েল করতে চায় চাটগাঁইয়া ভাষাকে। ক্ষয়িঞ্চু জমিদারের মত চাটগাঁইয়াকে দাবি করেন বাংলার আঞ্চলিকভাষা। কিন্তু চাটগাঁইয়া ভাষার অবোধ্যতা ও উচ্চারণ নিয়ে পরিহাস করার হীন মানসিকতা লুকোতে পারেন না। কি অদ্ভুত স্ববিরোধীতা! বাংলাভাষীরা চাটগাঁইয়া ভাষা বুঝতে না পেরে চাটগাঁইয়াদের বিদেশী বলে গালি দেন, অথচ তাঁদের বুঝতে না পারার ভেতরেই যে চাটগাঁইয়ার স্বতন্ত্রতা নিহিত আছে, চাটগাঁইয়া যে একটি আলাদা ভাষা, এবং এটিই যে চাটগাঁইয়াদের মাতৃভাষা তা তাঁরা স্বীকার করে না।
ভাষা সচেতন বাঙালি মাত্রই জানেন, বাংলা এবং অসমিয়া বর্ণমালায় অনেক মিল আছে। দুইভাষায় শব্দ, এমনকি অনেকক্ষেত্রে পুরো বাক্যেরও মিল রয়েছে। আবার বাংলাভাষার সাথে চাকমা ভাষার পার্থক্য কোথাও অসমীয়ার মত, কোথাও চাটগাঁইয়ার মত। চাটগাঁইয়া ও চাকমা ভাষায় আন্তঃস্বরীয় অঘোষ ধ্বনি লুপ্ত হয়। চাকমাদের মধ্যে প্রচলিত কথ্য ভাষার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে ষ্পষ্টত: প্রমাণিত হয়, তা চাটগাঁইয়া ভাষারই একটা নিকটতম অপভ্রংশ। চাটগাঁইয়ার অপভ্রংশের মতো উচ্চারণ রীতি ব্যবহার করলেও চাকমা ভাষার বর্ণমালা বর্মী আদলে তৈরি।
কথাসাহিত্যিক বিপ্রদাশ বড়ুয়া তার ‘নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও বাংলা’ প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘চাকমাদের ভাষা হিন্দ-আর্য শাখার অন্তর্ভূক্ত। তাদের ভাষা চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষার নিকটবর্তী। তাদের হরফের সঙ্গে কম্বোডিয়ার মনমের হরফ এবং বর্মী হরফের সাদৃশ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন চাকমারা আসামে বসবাসের সময় শানদের কাছ থেকে এই হরফ পেয়ে থাকবেন। চাকমা সাহিত্য উন্নত, বাংলা হরফেও এই সাহিত্য রচিত হয়।’ ভাষাতাত্ত্বিকরা বলেন, চাকমা আদতে একটি ভোট-বর্মীদলের ভাষা হয়েও ইন্দো-ইউরোপিয়দলের ভাষায় অপসারিত হয়েছে। এতে আন্দাজ করা যায়, চাকমাদের বহু আগেই চাটগাঁইয়া ভাষা সে পথে হেঁটেছে। যার কারণে আজকের চাটগাঁইয়াকে বাংলার আঞ্চলিক বা উপভাষা বলার চর্চা হয়। মূল কথা হচ্ছে- ভাষাতাত্ত্বিক এত মিল-মহব্বত ও যুক্তির পরও অসমিয়া এবং চাকমা আলাদা ভাষার স্বীকৃতি পেলে চাটগাঁইয়া কেন অবহেলার পাত্র হবে? তাই স্বভাবতই বাংলাভাষীদের প্রতি চাটগাঁইয়া ভাষাভাষীর প্রশ্ন; বাংলা-অসমিয়ার যত মিল তার চেয়ে বেশী অমিল থাকার পরও কেন চাটগাঁইয়া স্বতন্ত্র ভাষার মর্যাদা পাবে না?
উপভাষা: উপরোল্লিখিত তথ্যগুলো ছাড়াও যেখানে নিজেরই একাধিক উপভাষা আছে সেখানে অন্যভাষার উপ বা আঞ্চলিক ভাষা হতে যাবে কেন চাটগাঁইয়া। বৃহত্তর অর্থে ভাগ করলে চাটগাঁইয়া ভাষা – রোঁয়াই ও চাডি দুইভাবে বিভক্ত। সুক্ষ বিবেচনায়- (১) কর্ণফুলী নদীর উত্তরতীর থেকে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পূর্ব ঢাল, (২) চন্দ্রনাথের পশ্চিম ঢাল থেকে ফেনী নদী, (৩) কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীর থেকে মাতামুহুরী নদী এবং (৪) মাতামুহুরীর দক্ষিণ তীর থেকে নাফনদী পর্যন্ত চারটি উপভাষা রয়েছে। সাহিত্যচর্চা: চাটগাঁইয়া ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি যে অসম্ভব নয় তার প্রমান এ ভাষার সমৃদ্ধ গীতসম্ভার। এ গীত তো বাংলাভাষীদের কাছে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। প্রচুর সংখ্যক ছড়া, কবিতার পাশাপাশি কথাসাহিত্যেও মজবুত হচ্ছে চাটগাঁইয়ার অবস্থান। ২০১১’র মহান একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে চাটগাঁইয়া ভাষার প্রথম গল্পগ্রন্থ- ‘মেইট্টাল’। অবশ্য অনেকে প্রশ্ন তোলেন- বাংলা বর্ণমালায় কেন চাটগাঁইয়া চর্চা? তাদের জ্ঞাতার্থে বলা যায়- বর্তমানে বাংলা বর্ণমালায় মণিপুরী, গারো, হাজং, মারমাসহ বিভিন্ন ভাষাভাষী তরুণ সাহিত্যিকরা সেসব ভাষায় নিয়মিত লিখছেন। আবার অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যের মূলধারায় প্রতিষ্ঠিত করছেন। তাহলে চাটগাঁইয়া কেন নয়?
নৃবিজ্ঞানীরা বলেন, ভাষাগত পার্থক্য জাতি সত্ত্বাতে বৈচিত্র্য আনে। মূল বাংলার সঙ্গে চাটগাঁইয়াদের জীবনাচরণগত পার্থক্য বা বৈচিত্র্য যেহেতু পরিস্কার, সেহেতু ভাষাগত পার্থক্যও সুনিশ্চিত। চাটগাঁইয়ার স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার করা যেমন বাংলাভাষীদের গোঁয়ার্তুমী; তেমনি উপ বা আঞ্চলিক ভাষার তকমা নিয়ে নিরবতা পালন হবে চাটগাঁইয়াদের কুপমুণ্ডুকতা। আসুন কূপ থেকে বেরিয়ে, ভাষার সমূদ্রে দেই দীঘল সাঁতার। বৈচিত্র্যতাকে উপভোগ করতে শিখি, কেননা বৈচিত্র্যের মাঝেই সৌন্দর্য বিদ্যমান।
লেখক: সাঈদ মঈন, শিক্ষার্থী ও চাটগাঁইয়া ভাষার তরুণ গবেষক।
(এই লেখার বিভিন্ন তথ্য ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
Comments