in ,

চিটাগং না চট্টগ্রাম?

চিটাগং না চট্টগ্রাম? ইংরেজিতে চিটাগং না বলে কেন চট্টগ্রাম লেখা হবে না, তা নিয়ে জল গড়িয়েছে অনেক, কিন্তু লেখার সময় এখন লিখছি চিটাগং। কেন চট্টগ্রাম নয়, তা নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সময় বোধ হয় এসেছে।

চিটাগং না চট্টগ্রাম? ইংরেজিতে চিটাগং না বলে কেন চট্টগ্রাম লেখা হবে না, তা নিয়ে জল গড়িয়েছে অনেক, কিন্তু লেখার সময় এখন লিখছি চিটাগং। কেন চট্টগ্রাম নয়, তা নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সময় বোধ হয় এসেছে।

প্রজাতির উৎপত্তির যেমন বিজ্ঞানসম্মত কার্যকারণ রয়েছে, তেমনি অন্য অনেক কিছুর মতো কোনো দেশের নামকরণের পেছনেও রয়েছে কার্যকারণলব্ধ উৎপত্তির ইতিহাস। ইতিহাসের ক্রমান্বয়িক ধারায় দেখা গেছে শাসক ও শাসনব্যবস্থা বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে কোনো কোনো অঞ্চলের নামেরও পরিবর্তন হয়েছে। সেই বদল হয়েছে শাসকের ইচ্ছানুযায়ী। আবার শাসনের ক্রমবিবর্তনে সে বদলানো নাম মুছে গিয়ে অঞ্চলটি আবার পরিচিত হয়ে উঠেছে তার পুরোনো কিংবা আদি নামে।

জন্মানোর পর শিশুকে যে নাম দেওয়া হয়, সে নাম শিশুটির বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার অস্থিমজ্জায় রক্ত-মাংসে, ভাবনায় ও চৈতন্যে এমনভাবে মিশে যায় যে সে নিজেকে তা থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। সে নাম তার ভালো কিংবা মন্দ কাজে ব্যাপ্ত বা সংকুচিত হয় বটে, কিন্তু তাতে তার নামের কোনো পরিবর্তন ঘটে না।

ইংরেজিতে চিটাগং না বলে কেন চট্টগ্রাম লেখা হবে না, তা নিয়ে জল গড়িয়েছে অনেক, কিন্তু লেখার সময় এখন লিখছি চিটাগং। কেন চট্টগ্রাম নয়, তা নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সময় বোধ হয় এসেছে। ইস্ট বেঙ্গল ডিসট্রিক্ট গেজেটরসের গেজেটর অব চিটাগং ডিসট্রিক্ট বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৩ সালে। মূল্যবান তথ্যসংবলিত সেই বইটিতে বিশদ ও সবিস্তারে চট্টগ্রামের ইতিহাস, এখানকার মানুষ, স্বাস্থ্য, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, সেই সময়কার বেতন-ভাতাদি, বাণিজ্যের নানা খুঁটিনাটি, যাতায়াতব্যবস্থা, জমির রাজস্ব পরিচালনা ব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা, কৃষিকর্ম ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে।

অর্থাৎ এই গ্রন্থটিকে সেই সময়ের চট্টগ্রামকে বিশদভাবে জানার একটি আকর গ্রন্থ বলা যেতে পারে। এই বইটির লেখক ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের দক্ষ কর্মকর্তা এল এস এস ওম্যালি। যাঁদের কাছে তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন, তাঁরা হলেন স্যার চার্লস অ্যালেন, যিনি ১৯০০ সালে চিটাগং সার্ভে ও সেটেলমেন্ট রিপোর্টটি তৈরি করেছেন এবং সেই সময়কার চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার এইচ লুসন সাহেব। ‘দ্য অরিজিন অব নেইম’ অর্থাৎ এই অঞ্চলের নামের উৎস খুঁজতে গিয়ে তিনি বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

প্রথমে উদ্ধৃত করেছেন বুদ্ধধর্মাবলম্বীদের ভাষ্য, চৈতকিয়াং কিংবা চৈতাগ্রাম, চৈতার অর্থ হলো বুদ্ধের স্মৃতিসৌধ, সেই থেকে সম্ভবত এই অঞ্চলের নাম চট্টগ্রাম। হিন্দুমতে চট্টগ্রামের আদি নাম ছিল চট্টলা। মুসলমান শাসক অধিগ্রহণের পরে সে নাম পরিবর্তন করে রাখা হলো চাটিগাঁও। মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে অর্থাৎ চাটি জ্বালিয়ে পীর বদর শাহ অশুভ প্রেতাত্মাদের তাড়িয়েছিলেন বলে এই নাম।

নবম শতকে আরাকানের এক রাজা এই অঞ্চলে রক্তক্ষয়ী অভিযান চালান। জয় করার পর সেই বিজয়কে চিহ্নিতকরণের উদ্দেশ্যে এই অঞ্চলের কোন একটি জায়গায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। নির্মাণ শেষে রাজা যে মন্তব্যটি করেন, স্মৃতিস্তম্ভ সেই পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ওঠে। মন্তব্যটি হলো, ‘তিসত- তা- গুং’ মানে পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া অনুচিত। একদিন আত্ম-অনুসন্ধানের পথ ধরে চিটাগংকেও হতে হবে চট্টগ্রাম।

কারণ, এই নামের সঙ্গে কত কিংবদন্তি, কত গাঁথা– লোককথা–উপকথা মিশে আছে বিশ্বখ্যাত ইতিহাস ও ভূগোলবিদ ব্যারনুলি তাঁর ডেসক্রিপশন হিস্টোরিক এট জিয়োগ্রাফিক ডি লিন্ডে (১৭৮৬) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ‘শাট’ মানে বদ্বীপ এবং গঙ্গা, এই দুয়ের সংযুক্তির ফলে এই জায়গার নামকরণ হয়েছে শাটগঙ্গা, যার মানে গঙ্গার সম্মুখে গড়ে ওঠা নগরী। স্যার উইলিয়াম জোন্স অনুমান করেছেন যে এই জায়গায় একটি অনন্যসুন্দর পাখি দেখা যেত; একটি দুটি নয়, ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা যেত। পাখিটির নাম ‘ছাতগ’। সেই থেকে বোধ করি চাটিগাঁ

সংস্কৃত পণ্ডিতেরা আবার অন্য ভাষ্য দিয়েছেন, বলেছেন চতুগ্রাম থেকে কালিকপ্রবাহ ও বিবর্তনে এর নাম হয়েছে চট্টগ্রাম। তবে তার সবিস্তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে প্রতিটি দেশের প্রতিটি অঞ্চলের নামের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস, জনশ্রুতি, নানা কথা, উপকথা ও কিংবদন্তি। সেন্ট পিটার্সবুর্গকে কমিউনিস্ট রাশিয়া নতুন নাম দিলেন লেনিনগ্রাদ। যেই বয়ে গেল পরিবর্তনের হাওয়া সেন্ট পিটার্সবুর্গবাসীরা আদি নামটি ফিরিয়ে দেওয়ার জোর দাবি তুলল। লেনিনগ্রাদ মুছে সেই প্রাচীন নগর আবার হয়ে গেল সেন্ট পিটার্সবুর্গ। কারণ, এই নামের পেছনে আছে এক দীর্ঘ ইতিহাস, আছে তার নৃতাত্ত্বিক ভিত্তি, আছে ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীর সম্পৃক্তি।

চিটাগং গ্যাজেটিয়ারে লেখক এ-ও উল্লেখ করেছেন যে ইংরেজ শাসকদের অনেক বদভ্যাসের মধ্যে একটি ছিল ‘ভালগারাইজেশন অব নেমস’ নামের বিকৃতি করা। এটা যে আমরা উপলব্ধি করিনি, তা কিন্তু নয়। ঢাকা এখন সারা পৃথিবীতে ঢাকা নামে পরিচিত, ড্যাক্কা (DACCA) নয়। বার্মা হয়ে গেছে মিয়ানমার, পিকিং বেইজিং, রেঙ্গুন ইয়াঙ্গুন, বম্বে মুম্বাই, ক্যালকাটা কলকাতা, তাহলে চিটাগং কেন চট্টগ্রাম নয়।

একদিন আত্ম-অনুসন্ধানের পথ ধরে চিটাগংকেও হতে হবে চট্টগ্রাম। কারণ, এই নামের সঙ্গে কত কিংবদন্তি, কত গাঁথা–লোককথা–উপকথা মিশে আছে, কত সুখ-দুঃখের, যুদ্ধ-বিগ্রহের, বীরত্ব ও রক্তক্ষয়ের, ঝড়-তুফান ও প্লাবনের স্মৃতি আছে জড়িয়ে। সুফি সাধকের পীর আউলিয়ার এই পুণ্যভূমির নাম চট্টগ্রামই থাকুক, এ দেশে যেমন, ভিনদেশের মানুষও ডাকুক এই নামে। তাঁরা জানুক এই প্রাচীনতম বন্দরনগর, যা ইবনে বাতুতাকে মুগ্ধ করেছিল ১৩৫০ সালে, যা আইন-ই-আকবরিতে উল্লিখিত আছে সমুদ্রপাশে সুন্দরতম নগরী বলে তার নাম চট্টগ্রাম।

কেন অহেতুক চিটাগং হবে। সেই কবে আমাদের রক্ত-মাংস চিবিয়ে আমাদের ঝাঁঝরা করে দিয়ে সব লুটেপুটে চলে গেছে ইংরেজ আর আমরা এখনো সেই নাম বহন করে চলেছি। এটা ভীষণ লজ্জার। ’৪৭-এ ভারত-পাকিস্তান, ’৭১-এ বাংলাদেশ, তবু ঔপনিবেশিক ভূতকে তাড়ানো গেল না। আসুন, সবাই মিলে আওয়াজ তুলি, চিটাগং নয়, এই সুন্দরতম অঞ্চলের নাম ‘চট্টগ্রাম’, বিশ্বের সবাই যেন সেই নামে চেনে, সেই নামে ডাকে…

লেখক : শান্তনু বিশ্বাস, সংগীত শিল্পী, সংস্কৃতি কর্মী

What do you think?

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

প্রাচীন চন্দনাইশ | সমৃদ্ধ এক জনপদ

প্রাচীন চন্দনাইশ | সমৃদ্ধ এক জনপদ

বাংলায় ইসলামের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম

বাংলায় ইসলামের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম