in

চাটগাঁ’র ভাষা, পার্সো-এরাবিক স্ক্রিপ্ট এবং কিছু কথা

চাটগাঁইয়া বা সিটাইঙ্গে/সিটাইঙ্গা ভাষা হচ্ছে ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠীর একটা ভাষা যেটা চট্টগ্রামের নেটিভ ল্যাঙ্গুয়েজ বলা যায়। ভাষা নিয়ে গবেষণাকারী ডেভিড পি ব্রাউনের সাইট এবং এথনোলগ অনুযায়ী এর অবস্থান টপ হান্ড্রেড ল্যাঙ্গুয়েজ এর মধ্যে ৬৭তম, যা গ্রীক, চেক, বুলগেরিয়ান, পশতু এবং সুইডিশের মতো ভাষা কে পেছনে ফেলে। বাংলাদেশের দক্ষিণের চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার জেলা পর্যন্ত এ ভাষার বিস্তার।ইতিহাস বলে বাংলায় ইসলাম প্রবেশের দ্বার চট্টগ্রাম। এছাড়াও চট্টগ্রাম এর কথা বলতে গেলে চলে আসে বার আউলিয়ার কথা, যাদের পুণ্যভূমি নামে এ অঞ্চল খ্যাত। অনেক ইতিহাসবিদদের মতে চট্টগ্রামের ইতিহাস ঢাকা কিংবা কলকাতার চাইতে পুরনো। বাংলা বা বঙ্গের আগে চট্টগ্রাম হরিকেল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।যাইহোক, একটা ভাষাকে রিপ্রেজেন্ট করতে গেলে ওই ভাষায় কথা বলা মানুষজনের আচার-ব্যবহার, কথার ধরন, শব্দের ভ্যারিয়েশন সহ অনেক জিনিস দেখা লাগে। ধ্বনিগত বৈচিত্র্য, উচ্চারণ গত জিনিসপত্র; এবং সেই সাথে এর অর্থবোধকতা।নেটিভ চাটগাঁইয়া হবার সুবাদে এবং উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব থাকার সুবাদে; সেই সাথে গ্রামে-শহরে পড়াশোনা, চাকুরী সহ অনেক কিছু মিলিয়ে সিটাইঙ্গে সহ অনেক ভাষার ভ্যারিয়েশন, উচ্চারণগত পার্থক্য সহ আরও অনেক বৈশিষ্ট্য অবজারভেশন একই সাথে ঘাঁটাঘাঁটি, পড়াশোনা এবং রিসার্চ এর সুযোগ হয়েছে। এবং এই অবজারভেশন টা এক যুগেরও বেশি। ভাষার যে ভ্যারিয়েশন, সেটা নিয়ে কথা বলতে গেলে লম্বা কাহিনী হয়ে যাবে; সেটা অন্য কোনো দিনের জন্য তোলা থাক।শব্দগত পার্থক্য অনেক বেশি ম্যাটার করে একটা ভাষাকে অন্য ভাষা থেকে আলাদা করতে এবং চাটগাঁইয়া ভাষার ক্ষেত্রে সেটা অলরেডি প্রমাণিত। এরপর আপনি যখন কোনো বর্ণমালা দিয়ে রিপ্রেজেন্ট করতে যান, তখন দেখতে হয় ওই এক্সিস্টিং স্ক্রিপ্ট এর সাথে ওই ভাষার বিষয়বস্তু কতটুকু যায় বা ফিট করে।সিটাইঙ্গে/সিটাইঙ্গা ভাষাতে নরমালি চ(ch), জ(dg), ছ(chh) সহ এরকম অনেক মহাপ্রাণ ধ্বনিই এক্সিস্ট করে না।ব্যাপারটাকে একটু ম্যাথমেটিকালি রিলেট করতে চাইলে যেটা দাঁড়ায়, তার সারমর্ম এই যে,”বাংলাতে যখন খ উচ্চারিত হয় সেটা ক এর সাথে খুব জোরে চাপ দিয়ে হ, আরেকটু মিনিংফুলি বললে ক কে হ ছেদ করে যায় ‘খ’ উচ্চারণ করতে। বাংলাতে অল্পপ্রাণ ধ্বনির সাথে মহাপ্রাণ ধ্বনির সম্পর্ক এটাই।পক্ষান্তরে সিটাইঙ্গে/সিটাইঙ্গা তে মহাপ্রাণ ধ্বনি এক্সিস্ট করে না।অল্পপ্রাণ ধ্বনিকে ছেদ না করে হালকা টাচ কিংবা স্পর্শ করে উচ্চারিত হয়। যেমন ভাই, ভাত এগুলো কে অনেকে বাই(ৱাই), বাত(ৱাত) এভাবে উচ্চারণ করে।”এছাড়াও শুধু চ,ছ,স এ তিনটাকে রিপ্লেস করে س কিংবা s এর মতো ধ্বনি। এ জায়গায় বাংলা কিংবা পূর্বী ইন্সপায়ার্ড স্ক্রিপ্ট গুলো এলিমিনেটেড হয়ে যাওয়ার ভালো একটা সম্ভাবনা থাকে।এছাড়াও কিছু কিছু ধ্বনি আছে যেগুলো বাংলা বা ইংরেজি স্টাইলে স্ট্রেইট(আ,ই,অ) উচ্চারিত না হয়ে অনেকটা কোণাকুণি কিংবা প্যাঁচানো স্টাইলে উচ্চারিত হয়। 

যেমন,দারগোয়/দারগোয়া(জ্বালানি কাঠ) এটার পারফেক্ট ফিট হচ্ছে  دَرغ

যারগোয়/যারগোয়া(দুষ্ট) زَرغَ বা শেষের গাইন(غ) বর্ণটা এদের পারফেক্ট করে তোলে।

এছাড়াও সংখ্যা নির্দেশক ধ্বনি গুলো যেমন, 

সারগোয়/সারগোয়া – চারটি (গাইন – غ)

তিননোয়া/তিননোয় – তিনটি (ওয়াও – و)

দশশোয়/দশশোয়া – দশটি(ওয়াও – و)

তাছাড়া আরও দেখানো যায়

যেমন, গাসসোয়/গাসসোয়া(গেঁছো – woody)- گَصَّ,

মাসসোয়/মাসসোয়া(মাছটি – This/that fish)  مَصَّ

এ দুটো শব্দকে পারফেক্ট ভাবে রিপ্রেজেন্ট করতে হলে শেষে ص বসানো লাগেই।এই জায়গাগুলোতে বাংলা কিংবা পূর্বী ইন্সপায়ার্ড স্ক্রিপ্ট ভালো একটা মার খেয়ে যায়। এরকম আরও বহু শব্দ আছে, এখানেই সীমাবদ্ধ না এরা।

এ তো গেল শব্দের এক ফাঁড়া, এছাড়াও অনেক শব্দ আছে যেগুলো দেখতে কিংবা উচ্চারণে একই হলেও স্থান, কাল পাত্র ভেদে অর্থ চেঞ্জ হয়।এরপরে চলে আসে টোনাল ব্যাপার স্যাপার, যেখানে আবার একই শব্দের উচ্চারণে ধ্বনিগত পার্থক্যের কারণে সম্পূর্ণ অর্থ চেঞ্জ হয়ে যায়। যেমন, ফইর। এ শব্দটার উচ্চারণ ভেদে তিন থেকে চারটা মিনিং আছে।দেখাই যাচ্ছে, এ জায়গায় বাংলা কিংবা পূর্বী ইন্সপায়ার্ড স্ক্রিপ্ট বিদঘুটে এবং ল্যাটিন কিংবা রোমান স্ক্রিপ্ট অতিদীর্ঘ।মোর ওভার, বাংলা দিয়ে রিপ্রেজেন্ট করাটা সিটাইঙ্গে/সিটাইঙ্গা র মতো স্বতন্ত্র একটা ভাষা কে বাংলার উপভাষা হিসেবেই প্রতীয়মাণ করে ঘুরেফিরে।এবার আসি পার্সো-এরাবিক কিংবা Nastaliq স্ক্রিপ্ট এর টপিকে।পোস্টের সাথে দেখানো ছবিটা অনেকেই দেখেছেন, অনেকেই এটার ব্যাপারে জেনেছেন। ভাষা নিয়ে গবেষণা করা সবচেয়ে সমৃদ্ধ সাইটগুলোর একটা হচ্ছে অমনিগ্লট। তাদের মতে ছবিতে দেখানো পার্সো-এরাবিক স্ক্রিপ্ট টা হচ্ছে চাটগাঁইয়া ভাষাকে রিপ্রেজেন্ট করতে সর্বপ্রথম ব্যবহৃত এবং ঐতিহাসিক স্ক্রিপ্ট। গুগল সার্চ ও আপনাকে একই তথ্য দিবে। এই স্ক্রিপ্ট টা প্রথমে দেখে অবশ্য আমি একটু তব্দা খাই, এটা কোন স্ক্রিপ্ট আবার! পরে নিজের মাতৃভাষার সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, এবং যেটা দেখা গেল সেটা এখানকার অনেকেই দেখেছেন,  বলেছেন এবং তারাও বিষয়টার সাথে এগ্রিড।বাংলা কিংবা পূর্বী ইন্সপায়ার্ড স্ক্রিপ্ট গুলো দিয়ে রিপ্রেজেন্ট করতে গেলে শুদ্ধতার হার সর্বোচ্চ ৫০% এর আশেপাশে, এখন এতটুকু পার্সেন্টেজ দিয়ে একটা ভাষাকে রিপ্রেজেন্ট করাটা কেমন দেখায় সেটা বিচারের ভার আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম।পার্সো-এরাবিক স্ক্রিপ্ট কিংবা Nastaliq দিয়ে রিপ্রেজেন্ট করতে গেলে শুদ্ধতার হার গিয়ে দাড়ায় ৯০-৯৫% কিংবা তারও বেশি।কিন্তু লেখার ব্যাপারে সন্দেহ থেকে গিয়েছিল।আরেকটু আগ্রহী হয়ে ফার্সি রাইটিং স্টাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি, স্টাডি শুরু করি। দেখলাম অ আ ই এ উ সহ দরকারি সব ধরনের রিপ্রেজেন্টেশন বিদ্যমান, হবেই না বা কেন; কারণ উর্দু, আরবি, ফার্সি দুনিয়ার তামাম সমৃদ্ধ ভাষাগুলোর কয়েকটি যাদের শব্দভাণ্ডার নাকি আবার যথেষ্ট এনরিচড। তাছাড়া আমাদের শব্দভান্ডারের অধিকাংশ আবার আরবি, ফার্সি, উর্দু থেকে ইনহেরিটেড।এবার আসে টোনাল ব্যাপার স্যাপার। এটার জন্য আমি দেখার চেষ্টা করি এই স্ক্রিপ্ট গুলো থেকে ইনহেরিটেড অন্যান্য স্ক্রিপ্টগুলো।এক্সিস্টিং স্ক্রিপ্ট এর বর্ণগুলোর সাথে স্রেফ কিছু স্বর নির্দেশক চিহ্ন জুড়ে দিলেই খেল খতম, পুরোদস্তুর একটা ভাষাকে আত্মপ্রকাশ করানো সম্ভব। এমনকি দরকার না হলে অনেক এক্সিস্টিং চিহ্নকেও বাদ দেয়া যায়। আরেকটা জিনিস হচ্ছে আবজাদ রাইটিং স্টাইল, এটা আবার নেটিভদের বুঝতে সুবিধা। তবে Nastaliq দিয়েই যে রিপ্রেজেন্ট করতে হবে এমনটা না। এটা ছাড়াও আরও কিছু স্টাইল কিংবা স্ক্রিপ্ট আছে। যেমন Naskh, Kufie, Ta’liq, Deewani ইত্যাদি।

এবার কিছু মিথ নিয়ে কথা বলা যাক।

* বাঙালী হয়ে চাটগাঁইয়া ভাষার আলাদা স্ক্রিপ্ট খোঁজেন, মানে কি!

এথনিসিটি নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রচুর গালি খাবো এখন। তবে নিজেদের ভাষায় নিজেদের স্ক্রিপ্ট এ বলতে লিখতে পারাটা আমার মনে হয় সবাই ডিজার্ভ করে। সিলেটি ভাইয়েরা তাদের নিজস্ব নাগরী স্ক্রিপ্ট রিকোভার করেছে, এখন প্র্যাকটিস করছে। সুতরাং এটা কোনো সমস্যা না। তাছাড়া বাংলা কিংবা পূর্বী ইন্সপায়ার্ড স্ক্রিপ্ট দিয়ে রিপ্রেজেন্ট করাটা এটাকে সেই উপভাষায় নিয়ে যায় ঘুরেফিরে।

* পার্সো-এরাবিক স্ক্রিপ্ট কেন? আরব প্রেমিক, বায়াসড মুসলিম হোমোফোব!!!!

ভাষা এবং স্ক্রিপ্ট এর কোনো ধর্ম নেই, মানুষও ফেরেশতা না।ইসলাম এসেছে ১৪০০ বছর আগে, তার বহু আগে থেকে আরবি ভাষা এবং স্ক্রিপ্ট এর প্রচলন আছে এবং সে যুগের ই_হু_দি এবং পৌত্তলিক সম্প্রদায় বিশুদ্ধ আরবি ভাষায় কথা বলা এবং প্র্যাকটিস করার জন্য বিখ্যাত ছিল। আরবি মুসলিমদের ভাষা, তারাই একমাত্র এটার একচ্ছত্র অধিকারী এই মিথ থেকে বের হয়ে আসুন আল্লাহর ওয়াস্তে। অনেক দেশে একটা ভালো অংশ নন মুসলিম যাদের নেটিভ ল্যাঙ্গুয়েজ আরবি।তাছাড়া পার্সো-এরাবিক স্ক্রিপ্ট এর পক্ষে আমাদের বহু নন মুসলিম ভাই বোনেরা সমর্থন জানিয়েছেন, তারাও সেটাই চান যেটা তাদের মাতৃভাষার সাথে বেস্ট ফিট করে।আরেকটা অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করি। প্রকৌশলবিদ্যার ছাত্র হলেও আমাদের কিছু এরাবিক কোর্স ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেগুলো সবারই করতে হয়। সেই কোর্সগুলোতে দেখা গেছে দুয়েকজন প্র্যাকটিসিং মুসলিম বাদে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নন মুসলিম ছাত্রছাত্রীরা মুসলিমদের চাইতে বেশি ভালো করেছে এবং নাম্বার পেয়েছে। আরবির মতো একটা ভিন্ন ভাষা নিয়ে তারা মুসলমানদের টপকে যায় যদি, তাহলে নিজেদের ভাষা তো তাদের আয়ত্তে আছে এটা ভিন্ন স্ক্রিপ্ট এ প্র্যাকটিস করতে সমস্যা হবার কথা না।যদিও সম্পূর্ণ নতুন এবং ভিন্ন স্ক্রিপ্ট এ কারোই আপত্তি থাকার কথা না।

যাইহোক, অনেক কিছু বলে ফেললাম। কাউকে আঘাত দিতে চাইনি। ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল।পরিশেষে, আমাদের মাতৃভাষা নিয়ে কাজ করা ভাইদের প্রতি আন্তরিক মোবারকবাদ। আল্লাহ তায়ালা আপনাদের উত্তম জাযা দান করুন।

This post was created with our nice and easy submission form. Create your post!

What do you think?

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

চট্টগ্রামের পাঠাগার

চট্টগ্রামের পাঠাগার

চট্টগ্রামের ইতিহাস - প্রাগৈতিহাসিক যুগ

চট্টগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : প্রাগৈতিহাসিক যুগ