বন্দরনগরী চট্টগ্রামে যানজট এখন নিত্যসঙ্গী নগরবাসীর। দিনকে দিন ভেঙে পড়েছে চট্টগ্রামের ট্রাফিক ব্যবস্থা। হাঁটা পথ যানবাহনে পাড়ি দিতে সময় লাগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। এজন্য ট্রাফিফ পুলিশের অব্যবস্থাপনাকে দায়ি করছে নগরবাসী।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সড়কে অবৈধ ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন, সড়ক দখল করে গাড়ি পার্কিং, উন্নয়ন কাজের জন্য যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি, লক্ষাধিক অবৈধ রিকশার দাপট, ফুটপাত বেদখল এবং সড়কের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যানবাহন চলাচল করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্টদের মতে, ট্রাফিক পুলিশের মামলা বাণিজ্য, টোকেন ও স্লিপ বাণিজ্য এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। চট্টগ্রাম নগরীতে একটি সিগন্যাল লাইটও সচল নেই। ট্রাফিক পুলিশ বাধ্য হয়ে হাতের ইশারায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে অনেক দুর্ভোগের মাঝে কিছুটা স্বস্তির সংবাদ হলো, নগরীর ৫৩টি মোড়ে অত্যাধুনিক সিগন্যাল লাইট স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)।
এবার চট্টগ্রাম নগরীর নগরবাসীর যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে একটু পর্যালোচনা করা যাক। প্রকাশিত সূত্রমতে, বিভিন্ন মাঠপর্যায়ের জরিপ ও গবেষণা বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায় ৭৫% নগরবাসীর পক্ষে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যাতায়াতের সুযোগ নেই। সর্বোচ্চ প্রায় ১৫% নগর যাত্রা হয় ব্যক্তিগত গাড়িতে। বাসার দরজায় কিংবা আঙিনায় গাড়ি সুবিধা পেতে প্রায় ২০% নগরবাসী যাত্রা করে সিএনজি কিংবা রিক্সায়। অন্যদিকে প্রায় ৪০% নগরবাসীর যাত্রা হয় অনির্ভরযোগ্য, অনিরাপদ ও নিম্নমানের বাস-টেম্পোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ গণপরিবহণে। এদের সঙ্গে প্রায় ২৫% নগরযাত্রার অন্যতম মাধ্যম হলো পথচলা। সেই হিসেবে প্রায় ৭০ ভাগ নগরবাসীকে প্রতিনিয়ত যাত্রার সম্পূর্ণ কিংবা কোন পর্যায়ে হেঁটে চলতে হয়।
অন্যদিকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের গণপরিবহণের বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণে দেখা যায়, বন্দরনগরী চট্টগ্রামে তিন ধরনের গণপরিবহণের জন্য ৪৬টি অনুমোদিত রুট আছে। এর মধ্যে অটো টেম্পোর রুট ১৬টি, হিউম্যান হলারের রুট ১৬টি এবং বাস-মিনিবাসের রুট আছে ১৪টি। প্রত্যেকটি অনুমোদিত রুটের বাইরে বিভিন্ন শ্রমিক-মালিক সংগঠন মর্জিমাফিক আরও অন্তত ৪০টি অবৈধ রুট তৈরি করেছে বলে প্রকাশিত সূত্র নিশ্চিত করেছে। এসব অনুমোদনহীন রুটে চলছে হাজার হাজার যানবাহন। যার অধিকাংশই ত্রুটিপূর্ণ ও বিআরটিএর নিবন্ধন নেই। এসব রুটে যাত্রী পরিবহণে নেই কোনো শৃঙ্খলা।
পাশাপাশি সমসাময়িক সময়ে বিভিন্ন গনমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বন্দরনগরীতে অবৈধ যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছে এক শ্রেণির ট্রাফিক পুলিশ। পাশাপাশি অবৈধ ৪০ রুটে চলাচল করা যানবাহন নিয়ন্ত্রণও মালিক-শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে মিলেমিশে করছে ট্রাফিক পুলিশ। মেয়াদোত্তীর্ণ ও অবৈধ যানবাহনের বেশির ভাগই চলছে ট্রাফিক পুলিশের টোকেন ও স্লিপের মাধ্যমে। সে সঙ্গে আছে মামলা বাণিজ্য। সিএনজি অটোরিকশা জব্দ করা বাবদ মালিকদের কাছ থেকে ৫-৭ হাজার টাকা আদায় করা হলেও রশিদ দেওয়া হয় মাত্র সাড়ে ৭০০ টাকার। এমন কারসাজি করছে ট্রাফিক বিভাগের চার প্রসিকিউশন শাখা। অর্থাৎ ট্রাফিক বিভাগে এখনো বাসা বেঁধে আছে অনিয়ম-দুর্নীতি, যার ফলে ভয়াবহ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
টেকসই ও সমতাভিত্তিক নগর যাতায়াতের জন্য বিশ্বমানের শহরগুলোতে পথচারীর পরিসর, স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা দিনকে দিন বাড়ানো হচ্ছে। তাই নগরবাসীকে যানজটের মতো ভয়াবহ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে, যাতায়ত ব্যবস্থার উন্নয়নে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে টেকসই নগর যাতায়াতকে প্রাধান্য দিতে হবে। পথচারী পরিসর নগরীর জন্য একটি আবশ্যকীয় গণপরিসর। অন্যদিকে নগর যাতায়াতে গণপরিবহণ ব্যবহার ও ফুটপাতে চলতে পারা সমতাভিত্তিক নগর সৃষ্টির প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাই নগরবাসীর নগর যাতায়াত নিরাপদ ও গতিময় করতে সর্বাগ্রে পথচারী চলাচল ও গণপরিবহণমুখী করার জন্য বৃহৎ বিনিয়োগ করা বাঞ্ছনীয়। কারণ সবচেয়ে বেশি নগরবাসী ফুটপাত ব্যবহার করে থাকে।
পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে নগরীর সব অবৈধ রিক্সা ও মোটরচালিত অন্যান্য যানবাহন উচ্ছেদ করতে হবে। পাশাপাশি নিরাপত্তা স্বার্থে ও নিয়মিত মনিটরিং এর জন্য রিক্সা ও সিএনজিতে বারকোডের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অন্যদিকে ফুটপাত অবৈধ দখলদারিত্ব বন্ধে, ফুটপাতে টাইলস স্থাপন করে ফেন্সিং রেলিংয়ের মাধ্যমে সাজানো যেতে পারে। এতে ফুটপাতের ওপর দোকান বসলে ক্রেতা সহজে বিক্রেতার কাছে যেতে পারবে না। ফলে নগরীর অধিকাংশ ফুটপাত অবৈধ দখলদারের হাতে চলে যাওয়া থেকে রক্ষা পাবে। পাশাপাশি বন্দরনগরীর সকল রাস্তায় ফুটপাত সংযোজনের জন্য আইন প্রণয়ন করে তার অধীনে কিছু বিধিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। যেমন- সড়কের পাশে সরকারি, আধাসরকারী কিংবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অব্যবহৃত জমি থাকলে, জনস্বার্থে তা পথচারী ও গণপরিবহণ সংযোজনের সুবিধার্থে তা অবমুক্ত করা যেতে পারে। পাশাপাশি যেকোনো পর্যায়েই আবাসিক, বাণিজ্যিক কিংবা শিল্প এলাকা তৈরি করলে বাধ্যতামূলকভাবে পথচারী পরিসর সংযোজন করতে হবে।
Comments